প্রকাশনা তথ্য
প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ
জুন ২০২৩, জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
প্রচ্ছদ
প্রকাশক
সুনীল আকাশ আত্মপ্রকাশ কেন্দ্র (SAAP) প্রকাশনা,
1215-40, Gordonridge Place,
Scarborough, Ontario : M1K 4H8, Canada.
দুটি গল্প
তিনটি প্রশ্ন
রাজা বুড়ো হয়ে গেছেন। অনেক বয়স হয়েছে তাঁর। চোখে আজকাল আর ভালোমতো দেখতে পান না। কথা কম শোনেন কানে। শরীরেও কোনও বল নেই। এই অবস্থায় রাজ্য পরিচালনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। রাজা মনে মনে ঠিক করলেন, তাঁর কোনও পুত্রের ওপর রাজ্যের ভার দেবেন। তার পর বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন নিরিবিলি শান্তিতে।
রাজার ছিল তিন ছেলে।
কাকে দেবেন তিনি এই রাজ্যের শাসনভার? সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে যোগ্য যে, তাকেই তো রাজ্যের ভার দেওয়া উচিত। কিন্তু কে সবচেয়ে বুদ্ধিমান? রাজা ভাবলেন, এর একটা পরীক্ষা নেওয়া দরকার।
একদিন সকালবেলা। রাজা তাঁর বড় ছেলেকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে। বললেন, ‘বাবা, আমার তো বয়স হয়েছে। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। এবার আমার বিদায়ের পালা। আমি চাই তোমাদেরই মধ্যে কেউ একজন রাজা হও।’
বড় ছেলে বিগলিতভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
রাজা বললেন, ‘তবে একটা ব্যাপার! আমি তিনটি প্রশ্ন করব। যার উত্তর ঠিক হবে সে হবে সিংহাসনে বসার যোগ্য।’
বড় ছেলে জিগ্যেস করল, ‘প্রশ্ন তিনটি শুনতে পারি কি বাবা?’
‘নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।’
রাজা বললেন, ‘পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ জিনিস কী? সবচেয়ে দ্রুতগামী আর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস কোনটা কোনটা?’
বড় ছেলে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল,
‘সবচেয়ে পরিপূর্ণ হচ্ছেন আপনি। সবচেয়ে দ্রুতগামী হচ্ছে আপনার বাহন লাল ঘোড়া। আর সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে আপনার স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের জননী।’
জবাব শুনে রাজা কোনও মন্তব্য করলেন না। মনে মনে বললেন—
‘অন্য ছেলেদের একই প্রশ্ন করে দেখব ওরা কী জবাব দেয়।’
রাজা ডেকে পাঠালেন মেজ ছেলেকে।
‘আমি তোমায় তিনটি প্রশ্ন করতে চাই।’
‘করুন।’
‘যদি তোমার উত্তর ঠিক হয় তবে তুমিই হবে আমার পরে এই দেশের রাজা।’
‘আপনি প্রশ্ন করুন রাজা।’
‘পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিপূর্ণ কী?’
‘আমিই সবচেয়ে পরিপূর্ণ। আমার সব আছে।’
‘সবচেয়ে দ্রুতগামী কী?’
‘আমার শিকারি কুকুর।’
‘আর সবচেয়ে সুন্দর কী?
‘সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে আমার বউ।’
‘ঠিক আছে বাবা, তোমার সঙ্গে আমার সওয়াল-জবাব শেষ।
তার পর ডেকে পাঠানো হল ছোট ছেলেকে।
রাজা বললেন, ‘তোমাকে পরীক্ষা করে দেখতে চাই। তোমার বুদ্ধি যাচাই করতে চাই। দেখতে চাই—তুমি রাজা হওয়ার জন্য কতখানি যোগ্য।’
‘আমি পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত রাজা।’
‘বেশ। আমি তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করব। তুমি যদি ভালোমতো উত্তর দিতে পার তবে তুমিই হবে রাজা।’
‘আমি তৈরি। প্রশ্ন করুন।’
‘পৃথিবীর সবচেয়ে পরিপূর্ণ কী?’
ছোট ছেলে একটু ভেবে নিল। তার পর বলল, ‘কেন রাজা? পৃথিবীতে পরিপূর্ণ হচ্ছে ফসলের মাঠ। ফসল ফললে পৃথিবী নিজেই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।’
‘বেশ! বেশ!! এবার বল, সবচেয়ে দ্রুতগামী কী?’
‘সবচেয়ে দ্রুতগামী হচ্ছে আমাদের চোখের দৃষ্টি।’
রাজা শুধালেন,
‘কেন?’
‘কারণ আমরা চোখ দিয়েই এক পলকে অনেক কিছু দেখে ফেলি। দূরের জিনিস, কাছের জিনিস—কী নয়।’
‘এবারে আমার তৃতীয় প্রশ্ন।’
‘বলুন।’
করজোড়ে প্রশ্নটা জানতে চাইল ছোট ছেলে।
‘পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কী?’
‘সুন্দর হচ্ছে প্রকৃতি। এই যে গাছপালা, পাহাড়, নদী, সাগর—এগুলো হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর।
বুড়ো রাজা খুশি হলেন।
‘আহা, দারুণ তোমার বুদ্ধি। খুব ভালো জবাব দিয়েছ। তোমাকেই আমি রাজা বানাতে চাই।’
ছোট ছেলে রাজার আসনে বসল। মন দিয়ে রাজ্য শাসন করতে লাগল এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার নাম ছড়িয়ে পড়ল দিক থেকে দিগন্তরে।
ভালো আর মন্দ
এক ছিল ভালো লোক। ভারি ভালো সে। দয়ার শরীর। সবার বন্ধু। খুব সৎ।
একদিন সে ঘুরতে বেরুল। ঘোড়ায় চেপে চলল দূরের দেশে। পথে দেখা হল এক লোকের সঙ্গে। ভালো শুধাল, ‘নাম কী তোমার ভাই?’
‘আমার নাম মন্দ। লোকে আমাকে এই নামেই জানে। তোমার নাম?’
“ভালো,
‘যাচ্ছ কোথায়?’
‘যাচ্ছি দূরের দেশে।
‘তোমার সঙ্গে আমিও যাব। নেবে আমায়?’
‘অবশ্যই। অবশ্যই।
ভালো আর মন্দ দুইজনে চলল। ধু ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে পথ। পিপাসায় প্রাণ ফেটে যায়। তাগড়া ঘোড়া হাঁপিয়ে ওঠে। পথে পড়ল এক মনোরম ঝরনা। ভালো বলল, ‘ঝরনার তীরে, গাছের ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিই।’
মন্দ বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু আমার যে খুব খিদে পেয়েছে। এখন দুপুর। আমাদের খাওয়াদাওয়া করে নেওয়া উচিত।’
ভালো নিজের খাবার বের করল। দু জনে ভাগ করে খেল সে খাবার। ভালোর খাবার শেষ হয়ে গেল। সে বলল,
‘কী ব্যাপার? তোমার খাবার বের করলে না?’
‘না, না, আমাকে যেতে হবে অনেক দূরের পথ। সঙ্গে খাবার না থাকলে তো না-খেয়ে মরে যেতে হবে।’
ভালো বুঝতে পারল, ওকে বোকা বানিয়েছে মন্দ লোকটি। এ রকম লোকের সাথে পথ চলতে নেই। মন্দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্যপথ ধরল ভালো।
যেতে যেতে, যেতে—
নেমে এল রাত্রি। চারিদিকে অন্ধকার। ভালো দেখতে পেল, সামনে রয়েছে একটা পাহাড়। সেই পাহাড়ের মধ্যে একটা গুহা। ঘোড়াটাকে বাইরে রেখে সেই গুহায় ঢুকে ভালো শুয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার দু চোখের পাতায় নেমে এল গভীর ঘুম।
মাঝরাত্রে হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকাতেই খুব অবাক হয়ে গেল ভালো। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে গুহায়। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে দিগন্ত। লোকটি দেখল গুহার ওপাশে কারা যেন ফিসফিস করছে। তাকিয়ে দেখে, একটি সিংহ, একটি বাঘ, একটি নেকড়ে আর একটি শেয়াল। তারা গল্প করছে। খুব গুরুতর কোনও বিষয় নিয়ে।
বাঘ বলল, ‘এই গুহার মুখে থাকে অনেকগুলি ইঁদুর। ওরা এরকম চাঁদনি রাতে আসর জমায়। ওদের আছে অনেক সোনার মোহর। এই মোহরগুলো যদি কোনও মানুষ পায় তবে সে হবে অনেক ধনবান।’ বাঘের কথা শেষ হতেই নেকড়ে বলল, ‘আমি এক রাজার কথা জানি। তার মেয়ের এক কঠিন অসুখ। এই অসুখ সারবে এক গাছের শেকড়ে। এই শেকড় আছে এক রাখালের কাছে। দুধ দিয়ে সেদ্ধ করে এই শেকড় খাওয়ালে কন্যার অসুখ সেরে যাবে।’
সবশেষে শেয়াল বলল, ‘এখান থেকে কিছু দূরেই রয়েছে হারিয়ে যাওয়া সুন্দর এক নগর। পাথরের আড়ালে সেই নগর চাপা পড়ে আছে।’
ভালো মন দিয়ে সব শুনল। মনে তার ভারি আনন্দ। এতদিন পরে ভাগ্য বুঝি তার খুলল। সে গুহা থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে এল বাইরে।
আর কী আশ্চর্য!
জোছনার সেই সোনালি আলোয় সে দেখল, ইঁদুরেরা সোনার মোহর নিয়ে খেলাধুলা করছে। কিচিরমিচির কিচিরমিচির গান জুড়েছে তারা। একটা মানুষ দেখেই প্রাণভয়ে ছুট লাগল ইঁদুরগুলো। ভালো এবার থলির মধ্যে পুরে নিল মোহরগুলো।
পরদিন সকালে।
ঘোড়ায় চেপে ভালো রওনা দিল সেই দূরের দেশে। পথে দেখা হল এক রাখাল ছেলের সঙ্গে। নেকড়ের কথা মনে পড়ল ভালোর। ভালো গিয়ে রাখালকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাই তোমার পশুগুলো এত মোটাসোটা। এর কারণ কী?’
রাখাল জানাল, ‘আমি এক রকম শেকড় সেদ্ধ করে খাওয়াই। এই শেকড় খেলে শরীর খুব পুষ্ট হয়।’
‘আমাকে এই শেকড় একটু দেবে ভাই?’
‘না হে ভাই, এই শেকড় আমি কাউকে দেই না।’
‘আমি তোমাকে সোনার মোহর দেব।’
রাখাল রাজি হল সঙ্গে সঙ্গে। শেকড় নিয়ে যত্ন করে থলেতে রাখল ভালো। তার পর ঘোড়া ছোটাল রাজপ্রাসাদের দিকে।
রাজার মন ভালো নেই। তার একমাত্র কন্যার অবস্থা মরমর। ভালো গিয়ে সরাসরি দেখা করল রাজার সঙ্গে।
‘হে রাজা, আমি রাজকন্যার অসুখ সারাতে এসেছি।’
রাজা বললেন, ‘তাই! ‘এতে আমি আনন্দিত। যদি তুমি পার তবে তোমাকে আমি মহামূল্যবান পুরস্কার দেব।’
ভালোকে তখন ভিতরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। বিছানায় কঙ্কালের মতো শুয়ে আছে রাজকন্যে। শরীর তার দুর্বল। ভালো বলল—
‘শিগগির আমাকে এক পেয়ালা খাঁটি দুধ এনে দাও।’
সেই দুধে শেকড়ের রস মিশিয়ে খাওয়াল। ধীরে ধীরে কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলে গেল রাজকন্যার চেহারা। শরীরে-মনে শক্তি ফিরে পেল সে। কয়েকদিন যেতেই রাজকন্যে একেবারে সুস্থ।
রাজা খুশি। রানি খুশি।
আনন্দের ঢল বইতে লাগল রাজ্যজুড়ে।
রাজা অনেক ধনসম্পদ পুরস্কার দিল ভালোকে।
আর সাত দিন ধরে চলল উৎসব। মহা ধুমধামে ভালোর সঙ্গে বিয়ে হল রাজকন্যের। রাজা চাইলেন, ভালো একদিন দায়িত্ব নেবে এই রাজ্যের। কিন্তু ভালো ভুলে যায়নি সেই হারিয়ে যাওয়া নগরীর কথা। যেখানে আছে সুন্দর ফুলের বাগান। সেখানে পাখি গান গায়। হরিণ ঘুরে বেড়ায়। আর পাহাড় থেকে নেমে আসে সুন্দর এক চঞ্চল ঝরনা। ভালো গিয়ে পাথর সরিয়ে আবিষ্কার করল সেই নগর। তার পর রাজকন্যেকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে কাটতে লাগল তার দিন।
এইভাবে কেটে গেল এক দিন, দুই দিন—
এক বছর, দুই বছর—
ভালো একদিন বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মনোরম বাতাস। রঙবাহারি ফুল। চারপাশে ফুলের গন্ধ। এমন সময় ভালো দেখতে পেল, ঘোড়ায় চেপে কে যেন আসছে এই বাগানের দিকেই।
লোকটিকে দেখেই চিনতে পারল ভালো। আরে, এই সেই পুরনো সহচর। লোকে যাকে মন্দ বলে চেনে। মন্দকে আদর-আপ্যায়ন করে বাড়িতে নিয়ে এল ভালো। ভালোর এই উন্নতিতে মনে মনে খুব হিংসে হল মন্দর। পেট পুরে খেল। আইঢাই ঢেঁকুর তুলল। তার পর শুরু হল গল্পগুজব।
মন্দ জানতে চাইল, ‘হঠাৎ করে তোমার এমন ভাগ্য ফিরে গেল। ব্যাপারটা কী?’
ভালো তখন বলল, ‘ভাইরে, সে অনেক কথা। তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রাত কাটাতে গেলাম এক গুহায়।’
মাঝখানে মন্দ বলে নিল, ‘ওহে বন্ধু আমার, তোমার সঙ্গে আমি সেদিন খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। তুমি সেসব মনে রাখনি তো!’
ভালো জানাল, ‘নাহে, ওসব কি আর মনে রেখেছি।’
তার পর ভালো সব খুলে বলল, একে একে এসব শুনে মন্দর চোখ উঠল কপালে। কালকেই, কালকেই সে যাবে পাহাড়ের গুহায়।
সন্ধ্যায় মন্দ গিয়ে আশ্রয় নিল গুহায়।
সে জেগে রইল। অপেক্ষা করতে লাগল সুযোগের। মাঝরাতে যথারীতি বাঘ, সিংহ, নেকড়ে ও শেয়াল এল।
সিংহ জোরে শ্বাস টেনে বলল, ‘আজকে কেমন মানুষের গন্ধ পাচ্ছি এখানে।’
বাঘ বলল, ‘তাই তো।’
নেকড়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই সে, যে মানুষটা আমাদের গোপন কথা শুনে ফেলেছিল একদিন।’
ঝটপট তারা খুঁজে বের করল ওকে।
বলেই মন্দের দেহটাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে খাওয়া শুরু করল ওরা।
আর এভাবেই মন্দ মারা গেল। ভালো তখন বাস করতে লাগল সুখে-শান্তিতে। মন্দের কোনওদিন জয় হয় না।
ভালোরা পৃথিবীতে চিরকাল পুরস্কারই পায়।
Post a Comment