প্রকাশনা তথ্য
প্রকাশকাল
১৩৩৭ বৈশাখ, ১৯৩০ এপ্রিল
প্রথম স্যাপ (SAAP) প্রকাশ ২০২১
প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ
১৪২৮ ভাদ্র, ২০২১ সেপ্টেম্বর
প্রচ্ছদ
১৩৩৭ বৈশাখ, ১৯৩০ এপ্রিল
প্রথম স্যাপ (SAAP) প্রকাশ ২০২১
প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ
১৪২৮ ভাদ্র, ২০২১ সেপ্টেম্বর
প্রচ্ছদ
প্রকাশক
Scarborough, Ontario : M1K 4H8, Canada.
সুনীল আকাশ আত্মপ্রকাশ কেন্দ্র (SAAP) প্রকাশনা,
1215-40, Gordonridge Place,Scarborough, Ontario : M1K 4H8, Canada.
আর্শীব্বাদ
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন বাউল-সঙ্গীত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এসম্বন্ধে পূর্ব্বেই তাঁর সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে আলাপ হয়েছিল, আমিও তাঁকে অন্তরের সঙ্গে উৎসাহ দিয়েছি। আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল-দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল-সুরের মিল ঘটেচে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন্ এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হ’য়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স,—শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল,
কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূৰ্ব্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হ’য়ে উঠেছিল। এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে, “তং বেদ্যং পরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ”—যাঁকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ-বেদনা। অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটিই শুন্লুম, তার গেঁয়ো সুরে, সহজ ভাষায়—যাঁকে সকলের চেয়ে জান্বার তাঁকেই সকলের চেয়ে না-জানবার বেদনা—অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু, তারই কান্নার সুর— তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। “অন্তরতর যদয়মাত্মা” উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন “মনের মানুষ” ব’লে শুন্লুম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেককাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেচি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না, তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেম্নি কাব্যরচনা, তেম্নি ভক্তির রস মিশেচে। লোকসাহিত্যে এমন অপূৰ্ব্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় ব’লে বিশ্বাস করিনে।
সকল সাহিত্যে যেমন লোকসাহিত্যেও তেম্নি, তার ভালমন্দের ভেদ আছে। কবির প্রতিভা থেকে যে রসধারা বয় মান্দাকিনীর মতো অলক্ষ্যলোক থেকে সে নেমে আসে; তারপর একদল লোক আসে যারা খাল কেটে সেই জল চাষের ক্ষেতে আনতে লেগে যায়। তারা মজুরি করে, তাদের হাতে এই ধারার গভীরতা, এর বিশুদ্ধিতা চ’লে যায়, কৃত্রিমতায় নানাপ্রকারে বিকৃত হ’তে থাকে। অধিকাংশ আধুনিক বাউলের গানের অমূল্যতা চ’লে গেছে তা চল্তি হাটের শস্তা দামের জিনিষ হ’য়ে পথে পথে বিকোচ্চে তা অনেক স্থলে বাঁধি বোলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ, —তার অনেকগুলোই মৃত্যুভয়ের শাসনে মানুষকে বৈরাগীদলে টান্বার প্রচারকগিরি। এর উপায় নেই, খাঁটি জিনিষের পরিমাণ বেশী হওয়া অসম্ভব, খাঁটির জন্যে অপেক্ষা কর্তে ও তাকে গভীর ক’রে চিন্তে যে ধৈৰ্য্যের প্রয়োজন তা সংসারে বিরল। এইজন্যে কৃত্রিম নকলের প্রচুরতা চল্তে থাকে। এইজন্যে সাধারণতঃ যে-সব বাউলের গান যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়, কি সাধনার কি সাহিত্যের দিক থেকে তার দাম বেশী নয়।
তবু তার ঐতিহাসিক মূল্য আছে। অর্থাৎ এর থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ভারতবর্ষীয় চিত্তের যে-একটি বড় আন্দোলন জেগেছিল সেটি মুসলমান অভ্যাগমরে আঘাতে। অস্ত্র হাতে বিদেশী এলো, তাদের সঙ্গে দেশের লোকের মেলা হোলো কঠিন। প্রথম অসামঞ্জস্যটা বৈষয়িক অর্থাৎ বিষয়ের অধিকার নিয়ে, স্বদেশের সম্পদের ভোগ নিয়ে। বিদেশী রাজা হ’লেই এই বৈষয়িক বিরুদ্ধতা অনিবাৰ্য্য হ’য়ে ওঠে। কিন্তু মুসলমান শাসনে সেই বিরুদ্ধতার তীব্রতা ক্রমশঃই কমে আস্ছিল কেননা তারা এই দেশকেই আপন দেশ ক’রে নিয়েছিল, সুতরাং দেশকে ভোগ করা সম্বন্ধে আমরা পরস্পরের অংশীদার হ’য়ে উঠ্লুম। তা ছাড়া, সংখ্যা গণনা করলে দেখা যাবে, এদেশের অধিকাংশ মুসলমানই বংশগত জাতিতে হিন্দু, ধৰ্ম্মগত জাতিতে মুসলমান। সুতরাং দেশকে ভোগ করবার অধিকার উভয়েরই সমান। কিন্তু তীব্রতর বিরুদ্ধতা রয়ে গেল ধৰ্ম্ম নিয়ে। মুসলমান শাসনের আরম্ভকাল থেকেই ভারতের উভয় সম্প্রদায়ের মহাত্মা যাঁরা জন্মেছেন তাঁরাই আপন জীবনে ও বাক্য-প্রচারে এই বিরুদ্ধতার সমন্বয়-সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছেন। সমস্যা যতই কঠিন ততই পরমাশ্চর্য্য তাঁদের প্রকাশ। বিধাতা এম্নি ক’রেই দুরূহ পরীক্ষার ভিতর দিয়েই মানুষের ভিতরকার শ্রেষ্ঠকে উদ্ঘাটিত ক’রে আনেন। ভারতবর্ষে ধারাবাহিক ভাবেই সেই শ্রেষ্ঠের দেখা পেয়েছি, আশা করি আজও তার অবসান হয়নি। যে-সব উদার চিত্তে হিন্দু-মুসলমানের বিরুদ্ধ ধারা মিলিত হ’তে পেরেচে, সেইসব চিত্তে সেই ধৰ্ম্মসঙ্গমে ভারত-বর্ষের যথার্থ মানস-তীর্থ স্থাপিত হয়েছে। সেইসব তীর্থ দেশের সীমায় বদ্ধ নয়, তা অন্তহীনকালে প্রতিষ্ঠিত। রামানন্দ, কবীর, দাদু, রবীদাস, নানক প্রভৃতির চরিতে এইসব তীর্থ চিরপ্রতিষ্ঠিত হ’য়ে রইল। এঁদের মধ্যে সকল বিরোধ সকল বৈচিত্র্য একের জয়বাৰ্ত্তা মিলিত কণ্ঠে ঘোষণা করেচে।
আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্চেন। অন্যদেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্য্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন ক’রে এসেচে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি, —এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েচে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্য্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কণ্ঠ মিলেচে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্ব্বরতা। বাঙলা দেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কি রকম কাজ ক’রে এসেচে, হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেচে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। এই জন্য মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন মহাশয় বাউল সঙ্গীত সংগ্ৰহ ক’রে প্রকাশ করবার যে উদ্যোগ করেচেন, আমি তার অভিনন্দন করি, —সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচার ক’রে না, কিন্তু স্বদেশের উপেক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে মানব-চিত্তের যে-তপস্যা সুদীর্ঘকাল ধ’রে আপন সত্য রক্ষা ক’রে এসেচে তারই পরিচয় লাভ কর্ব এই আশা ক’রে।
পৌষ-সংক্রান্তি, ১৩৩৪
“কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।”
আমার মনের মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।”
কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূৰ্ব্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হ’য়ে উঠেছিল। এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে, “তং বেদ্যং পরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ”—যাঁকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ-বেদনা। অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটিই শুন্লুম, তার গেঁয়ো সুরে, সহজ ভাষায়—যাঁকে সকলের চেয়ে জান্বার তাঁকেই সকলের চেয়ে না-জানবার বেদনা—অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু, তারই কান্নার সুর— তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। “অন্তরতর যদয়মাত্মা” উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন “মনের মানুষ” ব’লে শুন্লুম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেককাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেচি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না, তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেম্নি কাব্যরচনা, তেম্নি ভক্তির রস মিশেচে। লোকসাহিত্যে এমন অপূৰ্ব্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় ব’লে বিশ্বাস করিনে।
সকল সাহিত্যে যেমন লোকসাহিত্যেও তেম্নি, তার ভালমন্দের ভেদ আছে। কবির প্রতিভা থেকে যে রসধারা বয় মান্দাকিনীর মতো অলক্ষ্যলোক থেকে সে নেমে আসে; তারপর একদল লোক আসে যারা খাল কেটে সেই জল চাষের ক্ষেতে আনতে লেগে যায়। তারা মজুরি করে, তাদের হাতে এই ধারার গভীরতা, এর বিশুদ্ধিতা চ’লে যায়, কৃত্রিমতায় নানাপ্রকারে বিকৃত হ’তে থাকে। অধিকাংশ আধুনিক বাউলের গানের অমূল্যতা চ’লে গেছে তা চল্তি হাটের শস্তা দামের জিনিষ হ’য়ে পথে পথে বিকোচ্চে তা অনেক স্থলে বাঁধি বোলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ, —তার অনেকগুলোই মৃত্যুভয়ের শাসনে মানুষকে বৈরাগীদলে টান্বার প্রচারকগিরি। এর উপায় নেই, খাঁটি জিনিষের পরিমাণ বেশী হওয়া অসম্ভব, খাঁটির জন্যে অপেক্ষা কর্তে ও তাকে গভীর ক’রে চিন্তে যে ধৈৰ্য্যের প্রয়োজন তা সংসারে বিরল। এইজন্যে কৃত্রিম নকলের প্রচুরতা চল্তে থাকে। এইজন্যে সাধারণতঃ যে-সব বাউলের গান যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়, কি সাধনার কি সাহিত্যের দিক থেকে তার দাম বেশী নয়।
তবু তার ঐতিহাসিক মূল্য আছে। অর্থাৎ এর থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ভারতবর্ষীয় চিত্তের যে-একটি বড় আন্দোলন জেগেছিল সেটি মুসলমান অভ্যাগমরে আঘাতে। অস্ত্র হাতে বিদেশী এলো, তাদের সঙ্গে দেশের লোকের মেলা হোলো কঠিন। প্রথম অসামঞ্জস্যটা বৈষয়িক অর্থাৎ বিষয়ের অধিকার নিয়ে, স্বদেশের সম্পদের ভোগ নিয়ে। বিদেশী রাজা হ’লেই এই বৈষয়িক বিরুদ্ধতা অনিবাৰ্য্য হ’য়ে ওঠে। কিন্তু মুসলমান শাসনে সেই বিরুদ্ধতার তীব্রতা ক্রমশঃই কমে আস্ছিল কেননা তারা এই দেশকেই আপন দেশ ক’রে নিয়েছিল, সুতরাং দেশকে ভোগ করা সম্বন্ধে আমরা পরস্পরের অংশীদার হ’য়ে উঠ্লুম। তা ছাড়া, সংখ্যা গণনা করলে দেখা যাবে, এদেশের অধিকাংশ মুসলমানই বংশগত জাতিতে হিন্দু, ধৰ্ম্মগত জাতিতে মুসলমান। সুতরাং দেশকে ভোগ করবার অধিকার উভয়েরই সমান। কিন্তু তীব্রতর বিরুদ্ধতা রয়ে গেল ধৰ্ম্ম নিয়ে। মুসলমান শাসনের আরম্ভকাল থেকেই ভারতের উভয় সম্প্রদায়ের মহাত্মা যাঁরা জন্মেছেন তাঁরাই আপন জীবনে ও বাক্য-প্রচারে এই বিরুদ্ধতার সমন্বয়-সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছেন। সমস্যা যতই কঠিন ততই পরমাশ্চর্য্য তাঁদের প্রকাশ। বিধাতা এম্নি ক’রেই দুরূহ পরীক্ষার ভিতর দিয়েই মানুষের ভিতরকার শ্রেষ্ঠকে উদ্ঘাটিত ক’রে আনেন। ভারতবর্ষে ধারাবাহিক ভাবেই সেই শ্রেষ্ঠের দেখা পেয়েছি, আশা করি আজও তার অবসান হয়নি। যে-সব উদার চিত্তে হিন্দু-মুসলমানের বিরুদ্ধ ধারা মিলিত হ’তে পেরেচে, সেইসব চিত্তে সেই ধৰ্ম্মসঙ্গমে ভারত-বর্ষের যথার্থ মানস-তীর্থ স্থাপিত হয়েছে। সেইসব তীর্থ দেশের সীমায় বদ্ধ নয়, তা অন্তহীনকালে প্রতিষ্ঠিত। রামানন্দ, কবীর, দাদু, রবীদাস, নানক প্রভৃতির চরিতে এইসব তীর্থ চিরপ্রতিষ্ঠিত হ’য়ে রইল। এঁদের মধ্যে সকল বিরোধ সকল বৈচিত্র্য একের জয়বাৰ্ত্তা মিলিত কণ্ঠে ঘোষণা করেচে।
আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্চেন। অন্যদেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্য্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন ক’রে এসেচে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি, —এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েচে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্য্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কণ্ঠ মিলেচে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্ব্বরতা। বাঙলা দেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কি রকম কাজ ক’রে এসেচে, হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেচে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। এই জন্য মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন মহাশয় বাউল সঙ্গীত সংগ্ৰহ ক’রে প্রকাশ করবার যে উদ্যোগ করেচেন, আমি তার অভিনন্দন করি, —সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচার ক’রে না, কিন্তু স্বদেশের উপেক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে মানব-চিত্তের যে-তপস্যা সুদীর্ঘকাল ধ’রে আপন সত্য রক্ষা ক’রে এসেচে তারই পরিচয় লাভ কর্ব এই আশা ক’রে।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শান্তিনিকেতন পৌষ-সংক্রান্তি, ১৩৩৪
লেখক সম্পর্কে
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন (৩১ জানুয়ারি, ১৯০৪ - ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭) ছিলেন বাংলাদেশী লোকসঙ্গীত, লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ। তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
১৯০৪ সালে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জায়দার আলী মাতার নাম জিউয়ারুন নেসা।
১৯২১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবাশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৬ সালে বি এ পাস করেন। ১৯২৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার্সে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে তিনি এমএ পাস করেন। তার আগে আর কোনো মুসলিম ছাত্র প্রথম শ্রেণী পায়নি। মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। লোকসাহিত্য সংগ্রহে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের আত্মনিবেদন ঘটে প্রবাসী পত্রিকা পাঠে, যা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত এবং পত্রিকাটির ওই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগৃহীত লালনের গান ছাপা হয়, যা কিশোর কবি মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনকে লালনের গান সংগ্রহে অনুপ্রেরণা জোগায়। পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। আহমদ শরীফের ভাষায়: নব যৌবনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ও অবনীন্দ্রনাথের আদরপুষ্ট হয়েছিলেন।
কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৩১ সালে সরকারি চাকুরী দিয়ে, স্কুল সাব ইন্সপেক্টর রূপে। বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার পর চাকুরী শেষ করেন ১৯৫৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর হিসেবে। ১৯৫২ সালে সরকারি মাসিক পত্রিকা মাহে নও এর সম্পাদক ছিলেন ছয় মাসের জন্য।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের প্রথম সংগ্রহ ছিল নিজ গ্রাম পাবনার মুরারীপুরের প্রেমদাস বৈরাগীর কাছ থেকে সংগৃহীত লালনের একটি গান পাঠিয়ে দেন প্রবাসীতে যা ছাপা হয় ১৩৩০ সালের আশ্বিন সংখ্যায়। তার মাধ্যমে আমরা পেয়েছি ত্রয়োদশ খণ্ডে হারামণির মতো লোকসংগীতের অমূল্য সংগ্রহ। এছাড়াও তিনি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার মতো তিন খণ্ডে বিভক্ত গবেষণাগ্রন্থ। তার রচিত মোট গ্রন্থসংখ্যা ৪২টি। অমূল্য সব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে-বিদেশে পেয়েছেন অনন্য সব সম্মান, স্বীকৃতি, সংবর্ধনা, পদক। তার জীবনের শতাব্দীর কয়েক দশক তিনি কাটিয়েছেন রাজধানী ঢাকাতেই। তার ছিল হুঁকোবিলাস ,জুতা ও ইংরেজিপ্রীতি। তিনি আসলে ছিলেন এক বিশ্ব মানব। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে তার ছিল নিবিড় যোগাযোগ। তাকে নিয়ে আসাদ চৌধুরী লিখেছেন: যে-গভীর সত্যবাণী নিরক্ষর গীতিকার কবিদের/ ঠোঁটে ঠোঁটে কেঁদে উঠেছিলো—/ তাকে তুমি ছড়ালে নিখিলে।
১৯০৪ সালে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জায়দার আলী মাতার নাম জিউয়ারুন নেসা।
১৯২১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবাশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৬ সালে বি এ পাস করেন। ১৯২৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার্সে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে তিনি এমএ পাস করেন। তার আগে আর কোনো মুসলিম ছাত্র প্রথম শ্রেণী পায়নি। মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। লোকসাহিত্য সংগ্রহে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের আত্মনিবেদন ঘটে প্রবাসী পত্রিকা পাঠে, যা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত এবং পত্রিকাটির ওই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগৃহীত লালনের গান ছাপা হয়, যা কিশোর কবি মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনকে লালনের গান সংগ্রহে অনুপ্রেরণা জোগায়। পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। আহমদ শরীফের ভাষায়: নব যৌবনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ও অবনীন্দ্রনাথের আদরপুষ্ট হয়েছিলেন।
কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৩১ সালে সরকারি চাকুরী দিয়ে, স্কুল সাব ইন্সপেক্টর রূপে। বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার পর চাকুরী শেষ করেন ১৯৫৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর হিসেবে। ১৯৫২ সালে সরকারি মাসিক পত্রিকা মাহে নও এর সম্পাদক ছিলেন ছয় মাসের জন্য।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের প্রথম সংগ্রহ ছিল নিজ গ্রাম পাবনার মুরারীপুরের প্রেমদাস বৈরাগীর কাছ থেকে সংগৃহীত লালনের একটি গান পাঠিয়ে দেন প্রবাসীতে যা ছাপা হয় ১৩৩০ সালের আশ্বিন সংখ্যায়। তার মাধ্যমে আমরা পেয়েছি ত্রয়োদশ খণ্ডে হারামণির মতো লোকসংগীতের অমূল্য সংগ্রহ। এছাড়াও তিনি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার মতো তিন খণ্ডে বিভক্ত গবেষণাগ্রন্থ। তার রচিত মোট গ্রন্থসংখ্যা ৪২টি। অমূল্য সব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে-বিদেশে পেয়েছেন অনন্য সব সম্মান, স্বীকৃতি, সংবর্ধনা, পদক। তার জীবনের শতাব্দীর কয়েক দশক তিনি কাটিয়েছেন রাজধানী ঢাকাতেই। তার ছিল হুঁকোবিলাস ,জুতা ও ইংরেজিপ্রীতি। তিনি আসলে ছিলেন এক বিশ্ব মানব। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে তার ছিল নিবিড় যোগাযোগ। তাকে নিয়ে আসাদ চৌধুরী লিখেছেন: যে-গভীর সত্যবাণী নিরক্ষর গীতিকার কবিদের/ ঠোঁটে ঠোঁটে কেঁদে উঠেছিলো—/ তাকে তুমি ছড়ালে নিখিলে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন'র রচনাসমূহ:
লোকসাহিত্য
১১ খণ্ডে সংগৃহীত লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্যের সংকলন হারামনি
লোককাহীনির সংকলন শিরণী (১৯৩২)
হাসি অভিধান
বাংলা ইডিয়ম সংকলন (১৯৫৭)
উপন্যাস
সাতাশে মার্চ
বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাস
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, ৩খন্ড একত্রে (১৯৮১)
গানের সংকলন
শত গান (১৯৬৭)
ইরানের কবি (১৩৭৫ বঙ্গাব্দ)
আওরঙ্গজেব (অনুবাদ, ১৯৭০)
শত গান (১৯৬৭)
রূপকথা সংকলন
ঠকামি (১৯৫৯)
মুসকিল আসান (২য় সং ১৯৫৯)
অন্যান্য
হাসির পড়া (১৯৬৩)
লোকসাহিত্য
১১ খণ্ডে সংগৃহীত লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্যের সংকলন হারামনি
লোককাহীনির সংকলন শিরণী (১৯৩২)
হাসি অভিধান
বাংলা ইডিয়ম সংকলন (১৯৫৭)
উপন্যাস
সাতাশে মার্চ
বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাস
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, ৩খন্ড একত্রে (১৯৮১)
গানের সংকলন
শত গান (১৯৬৭)
ইরানের কবি (১৩৭৫ বঙ্গাব্দ)
আওরঙ্গজেব (অনুবাদ, ১৯৭০)
শত গান (১৯৬৭)
রূপকথা সংকলন
ঠকামি (১৯৫৯)
মুসকিল আসান (২য় সং ১৯৫৯)
অন্যান্য
হাসির পড়া (১৯৬৩)
Post a Comment