প্রকাশনা তথ্য
প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ
জুন ২০২৩, জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
প্রচ্ছদ
প্রকাশক
সুনীল আকাশ আত্মপ্রকাশ কেন্দ্র (SAAP) প্রকাশনা,
1215-40, Gordonridge Place,
Scarborough, Ontario : M1K 4H8, Canada.
কয়েকটি বক্তৃতা
জনসমক্ষে প্রথম বক্তৃতা
ইলিনয় জেনারেল অ্যাসেম্বলীর সদস্যপদের প্রার্থীরূপে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া লিঙ্কন জনসমক্ষে সর্বপ্রথম বক্তৃতা করেন। তখন ১৮৩২ সাল—তাঁহার বয়স ছিল তেইশ। এখানে বক্তৃতার যে অংশগুলি উদ্ধৃত হইয়াছে তাহাতে স্থানীয় বিষয় সম্পর্কে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে তাঁহার মতামতগুলির বিস্তৃত বিবরণ বাদ দেওয়া হইয়াছে, তবে এই উদ্ধৃতিগুলি হইতে তদানীন্তন বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাঁহার মতামতের পরিচয় পাওয়া যাইবে।
নাগরিক বন্ধুগণ :
এই রাষ্ট্রের পরবর্তী জেনারেল অ্যাসেম্বলীতে বরণীয় প্রতিনিধিপদগুলির জন্য আমি অন্যতম নির্বাচন প্রার্থী হইয়াছি। চিরাচরিত প্রথা এবং খাঁটি রিপাবলিকান নীতি অনুসারে স্থানীয় সমস্যাবলী সম্পর্কে আমার মনোভাব আপনাদিগকে অর্থাৎ যাহাদের প্রতিনিধিরূপে আমি নির্বাচিত হইতে চাহিতেছি তাহাদিগকে জানান আমার কর্তব্য।
অতীতের অভিজ্ঞতায় জনকল্যাণে অভ্যন্তরীণ উন্নতির গুরুত্ব প্রমাণিত হইয়াছে। নিজ নিজ সঙ্গতি অনুযায়ী উত্তম রাস্তা তৈয়ারী করিলে ও নদীগুলিকে নৌচলাচলের উপযোগী করিয়া তুলিলে সর্বাপেক্ষা জনবিরল দরিদ্রতম দেশগুলিও যে উপকৃত হইবে একথা কেহ অস্বীকার করিবেন না। কিন্তু তথাপি কাজ সম্পন্ন করিবার সামর্থ্য আছে কিনা অগ্রে তাহা বিবেচনা না করিয়া ঐরূপ বা অপর কোন কাজ হাতে লওয়া নির্বুদ্ধিতা—কারণ অর্ধসমাপ্ত কাজ শ্রমের অপব্যয় ব্যতীত আর কিছুই নহে...
শিক্ষার বিষয় সম্পর্কে, কোন পরিকল্পনা বা কোন পদ্ধতি জোর করিয়া চাপাইবার কোন ইচ্ছা আমার নাই; আমি কেবল বলিতে চাহি যে বিষয়টিকে আমাদের সমগ্র কার্যাবলীর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া আমি মনে করি। প্রত্যেক ব্যক্তি অন্ততঃ মোটামুটি শিক্ষা লাভ করিয়া স্বদেশ ও বিদেশের ইতিহাস পড়িতে সক্ষম হইবে এবং তদ্বারা আমাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত আচার ও বিধির যথার্থ মূল্য উপলব্ধি করিতে পারিবে—কেবলমাত্র এই জন্যই শিক্ষার বিষয়টির গুরুত্ব অপরিহার্য—ধর্মপুস্তক এবং ধর্ম ও নীতি সম্পর্কীয় গ্রন্থাবলী পাঠে সমর্থ হইয়া জনসাধারণ যে সুবিধা ও সন্তোষ লাভ করিবে তাহার কথা না হয় নাই বলিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই দিনের প্রতীক্ষা করিতেছি, যখন শিক্ষা ও তাহার মাধ্যমে নীতিপরায়ণতা, সংযম, উদ্যম এবং অধ্যবসায় জনগণের মধ্যে বর্তমান অপেক্ষা ব্যাপকতর হইবে; সেই সুখময় সময়কে ত্বরান্বিত করিতে পারে এমন কোন ব্যবস্থা অবলম্বনের সুযোগ পাইলে আমি আনন্দিত হইব...
যৌবনে লোকের যতটা বিনয়ী হওয়া উচিত, সেই বিচারে সম্ভবতঃ আমি শোভনতার সীমা লঙ্ঘন করিয়াছি। তবে আলোচ্য বিষয়গুলি সম্পর্কে আমার যাহা অভিমত আমি তাহাই বলিয়াছি। কোন একটি, এমন কি সকল বিষয়েই হয়তো আমার ধারণা ভ্রান্ত হইতে পারে; কিন্তু আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি যে সর্বদা ভ্রান্ত হওয়া অপেক্ষা কোন কোন সময় সময় সঠিক পথে চলা শ্রেয়তর; এবং সেই কারণে যে মুহূর্তে আমার অভিমতের ভ্রান্তি উপলব্ধি করিব তৎক্ষণাৎ তাহা পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত থাকিব।
প্রত্যেক মানুষেরই নাকি বিচিত্র এক উচ্চাকাঙ্খা আছে। সে কথা সত্য হউক বা মিথ্যা হউক, আমি অন্ততঃ বলিতে পারি যে, নিজেকে জনসাধারণের শ্রদ্ধাস্পদ করিয়া তাহাদের শ্রদ্ধা অর্জন করা অপেক্ষা শ্রেয়তর কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নাই। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিতে আমি কতদূর সফল হইব তাহা ভবিষ্যতই বলিতে পারে। আমি অল্পবয়স্ক এবং আপনাদের অনেকেরই নিকট অপরিচিত। আমি অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় জন্মগ্রহণ করিয়াছি এবং এখনও সেই অবস্থাতেই আছি। আমার হইয়া সুপারিশ করিবার মত বিত্তশালী কোন আত্মীয় আমার নাই। আমার ভবিষ্যত সম্পূর্ণরূপে এই দেশের স্বাধীন ভোটদাতাগণের উপর নির্ভর করিতেছে; আমি যদি নির্বাচিত হই তবে তাহাদের অনুগ্রহেই হইব এবং সেই অনুগ্রহের মূল্য দিবার জন্য আমি অবিরাম পরিশ্রম করিয়া যাইব। কিন্তু যদি সজ্জনেরা আমাকে অন্তরালে রাখাই শ্রেয় মনে করেন তবে আমি বিশেষ ব্যথিত হইব না, কারণ আমি জীবনে অনেক আশাভঙ্গের বেদনা সহিতে অভ্যস্ত।
আপনাদের বন্ধু ও সহ-নাগরিক,
এ. লিঙ্কন
নিউ সালেম, মার্চ ৯, ১৮৩২
জনৈক আত্মীয়ের প্রতি পরামর্শ
লিঙ্কন দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পার্থিব উন্নতির ফলে আত্মীয়-স্বজন প্রায়ই তাঁহার নিকট সাহায্যের প্রত্যাশী হইতেন এবং সাধারণতঃ তিনি তাহাদিগকে সাহায্য দিতেন। ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে যখন কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে তিনি ওয়াশিংটনে ছিলেন তখন তিনি তাঁহার জনৈক শ্যালককে প্রার্থিত সাহায্যের পরিবর্তে কয়েকটি বিশেষ মূল্যবান উপদেশ দেন।
প্রিয় জনষ্টন :
তুমি আশি ডলারের জন্য যে অনুরোধ করিয়াছ তাহা রক্ষা করা বর্তমানে আমি সমীচীন মনে করি না। ইতঃপূর্বে আমি তোমাকে যে কয়েকবার সাহায্য করিয়াছি তখন তুমি বলিয়াছ, “এখন হইতে আমরা ভালভাবে চলিতে পারিব।” কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তোমার সমস্যা পুনরায় দেখা দিত। তোমার চরিত্রের কোন দুর্বলতার জন্যই নিশ্চয় এরূপ ঘটে। সেই দুর্বলতাটি কি, মনে হয় আমি তাহা জানি। তুমি অলস নও, কিন্তু তুমি কুঁড়েমি কর। তোমার সহিত যতদিনের পরিচয় তন্মধ্যে তুমি কোনদিনও সম্পূর্ণ দিনের কাজ করিয়াছ কিনা আমার সন্দেহ আছে। তুমি যে কাজ করিতে অনিচ্ছুক তাহা নহে, কিন্তু তথাপি তুমি বিশেষ কাজ কর না কেবল এইজন্য যে তদ্বারা তোমার বিশেষ লাভ হইবে বলিয়া তুমি মনে কর না। এইভাবে অনর্থক সময় নষ্ট করার অভ্যাসই সংকটের মূল, তোমার এবং বিশেষভাবে তোমার সন্ততিবর্গের স্বার্থেই তোমার এই অভ্যাস বর্জন করা উচিত। তোমার সন্তানদের নিকট ইহার গুরুত্ব সমধিক এই কারণে যে তাহারা অধিক দিন বাঁচিয়া থাকিবে; এবং একবার অলস অভ্যাস জন্মাইলে উহা কাটানো অপেক্ষা ঐ অভ্যাস জন্মাইতে না দেওয়াই ভাল।
তোমার এখন কিছু [নগদ] অর্থের প্রয়োজন; আমার পরামর্শ হইল অর্থের বিনিময়ে তুমি মনে প্রাণে কাহারও কোন কাজে লাগিয়া যাও। পিতা এবং তোমার পুত্রদের উপর বাড়ীর ভার ছাড়িয়া দাও—তাহারা শস্য উৎপাদন করুক; তুমি অর্থকরী কোন কাজে বা ঋণ পরিশোধের কোন কাজে লাগিয়া যাও। যাহাতে তুমি উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাইতে পার সেজন্য আমি প্রতিশ্রুতি দিতেছি যে আজ হইতে ১লা মে’র মধ্যে তুমি নিজের শ্রমে, নগদ বা ঋণ বিনিময়ে, যত ডলার উপার্জন করিবে আমি তোমাকে আরও তত ডলার দিব। ফলে যদি তুমি মাসিক দশ ডলারে কোন কাজ নাও, তবে আমার নিকট হইতে আরও দশ ডলার পাইবে এবং আয় মাসিক কুড়ি ডলার হইবে। ইহার অর্থ এই নহে যে আমি তোমাকে সেণ্ট লুইয়ে, কিংবা সীসার খনিতে বা ক্যালিফোর্নিয়ার সোনার খনিতে যাইতে বলিতেছি; আমি বলিতে চাই যে কোল্স কাউন্টিতে তোমার বাড়ীর নিকট তুমি যত বেশী মজুরী পাও তাহাতেই কোন কাজে লাগিয়া যাও। তুমি যদি এরূপ কর, শীঘ্রই তুমি ঋণমুক্ত হইবে এবং তদুপরি তোমার এমন অভ্যাস জন্মিবে যাহার ফলে ভবিষ্যতে পুনরায় ঋণগ্রস্ত হইবে না। কিন্তু যদি আমি তোমাকে এখন ঋণমুক্ত করিয়া দিই তবে আগামী বৎসর পুনরায় তুমি এরূপভাবেই ঋণগ্রস্ত হইবে। তুমি বলিয়াছ যে সত্তর-আশি ডলার এক্ষণে তোমার নিকট স্বর্গের সমতুল। তুমি স্বর্গকে অত্যন্ত সস্তা ভাবিতেছ; আমি সুনিশ্চিত জানি যে আমার পরামর্শমত চলিলে তুমি চার-পাঁচ মাস কাজ করিয়াই সত্তর বা আশি ডলার সংগ্রহ করিতে পারিবে। তুমি বলিতেছ যে আমি যদি তোমাকে প্রার্থিত অর্থ দিই তুমি আমার নিকট জমি বন্ধক রাখিবে এবং অর্থ পরিশোধ করিতে অসমর্থ হইলে আমাকে জমির অধিকার ছাড়িয়া দিবে। ইহা নিতান্তই নির্বোধের ন্যায় উক্তি। জমি থাকা সত্ত্বেও যদি তুমি এখন জীবন নির্বাহ করিতে অপারগ হও, তবে জমি ছাড়া তুমি কী ভাবে চলিবে? তুমি সর্বদাই আমার প্রতি সদয় ব্যবহার করিয়াছ; আমি তোমার প্রতি নির্দয় হইতে চাহিনা। বরং তুমি যদি কেবল আমার পরামর্শ অনুসারে চল, তবে তুমি দেখিতে পাইবে তাহার মূল্য আশি ডলার কেন, তাহার আটগুণেরও বেশি।
স্নেহানুরক্ত তোমার ভ্রাতা,
এ. লিঙ্কন
দাসত্বসম্পর্কে প্রথম বক্তৃতা
১৮৫৪ সাল নাগাদ দাসত্ব সমস্যা মার্কিন রাজনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইয়া দাঁড়ায়। তখন পশ্চিমদিকে প্রসারের যুগ। এই প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যে সকল নূতন রাষ্ট্র ইউনিয়নে যোগদান করিতেছিল মূলতঃ তাহাদের সম্পর্কেই সমস্যাটি দেখা দিয়াছিল। পরবর্তীকালে লিঙ্কনের প্রবলতম প্রতিপক্ষ সেনেটার স্টীফেন এ. ডগলাস-এর বক্তৃতার উত্তরে ১৮৫৪ সালের অক্টোবর মাসে ইলিনয়ের অন্তর্গত পিওরিয়া (Peoria) নামক স্থানে তিনি যে বক্তৃতা করেন তাহাই এ বিষয়ে তাঁহার সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা। ডগলাস প্রথমে বক্তৃতা দেন। তাঁহার মত লিঙ্কনও প্রায় তিন ঘণ্টার অধিককাল বক্তৃতা করেন। উদ্ধৃত অংশে এ বিষয় সম্পর্কে তাঁহার মূল মতবাদের পরিচয় পাওয়া যায়।
“দক্ষিণের প্রতি সম-আচরণের” নীতির জন্য নূতন দেশগুলিতে দাস-প্রথা বিস্তারে আমাদের সম্মতি দেওয়া কর্তব্য বলিয়া বলা হয়। ইহার অর্থ হইল এই যে আমি আমার শূকরটিকে নেব্রাস্কা লইয়া গেলে আপনি যখন আপত্তি করেন না, আপনি আপনার ক্রীতদাসকে লইয়া গেলে আমারও আপত্তি করা উচিত নয়। যদি শূকর ও নিগ্রোদের মধ্যে কোন পার্থক্য না থাকে তবে এই যুক্তিতে যে গলদ নাই তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। এই ভাবে নিগ্রোদের মানবতা অস্বীকার করিতে যদি আপনারা আমাকে বাধ্য করিতে চাহেন, তবে আপনারা যাহারা দক্ষিণে থাকেন তাহাদিগকে আমি প্রশ্ন করিব, আপনারাও কি কখনও তাহা করিয়াছেন? ভগবানের সদয় বিধানে, পৃথিবীতে যাহারা আসে তাহাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় লোকই স্বভাব-দুর্বৃত্ত হয়। স্বাধীন রাষ্ট্র অপেক্ষা দাস রাষ্ট্রে তাহাদের শতকরা হার অধিক নহে। উত্তর অঞ্চলেই থাকুন বা দক্ষিণ অঞ্চলেই থাকুন, জনসাধারণের অধিকাংশের মধ্যে মানবিক সহানুভূতিবোধ রহিয়াছে—দৈহিক বেদনাবোধ যেমন তাঁহারা এড়াইতে পারেন না সেরূপ এই সহানুভূতিবোধকেও তাঁহারা কাটাইতে পারেন না। দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের এই প্রকৃতিগত সহানুভূতি হইতে অনেকভাবে প্রকাশ পায় যে তাঁহারা দাসপ্রথাকে অন্যায় বলিয়া মনে করেন এবং নিগ্রোদের মধ্যেও যে মানবতা রহিয়াছে সে বিষয়ে তাঁহারা সচেতন। যদি একথা তাঁহারা অস্বীকার করেন, আমি তাঁহাদিগকে কয়েকটি সহজ প্রশ্ন করিব—১৮২০ সালে আপনারা প্রায় একবাক্যে উত্তরাঞ্চলের জনসাধারণের সহিত সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, আফ্রিকা হইতে দাস আনিয়া ব্যবসা করা জলদস্যুতার সামিল এবং তাহার সমুচিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কেন তাহা করিয়াছিলেন? যদি আপনারা উহা অন্যায় মনে না করিয়া থাকেন তবে কেন ইহার জন্য মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইবার বিধান প্রণয়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ হইয়াছিলেন? ঐ প্রথাতে আফ্রিকা হইতে বন্য নিগ্রোদের আনিয়া ক্রয়েচ্ছুক ব্যক্তিদের নিকট বিক্রয় করা ছাড়া আর কিছু করা হইত না। কিন্তু বন্য অশ্ব, বন্য মহিষ বা বন্য ভল্লুক ধরিয়া আনিয়া বিক্রয় করিবার জন্য কাহাকেও ফাঁসি দিবার কথা তো চিন্তা করেন নাই।
আবার, আপনাদের মধ্যে দেশীয় দুরাত্মাদের মত একদল নীচ ব্যক্তি রহিয়াছে যাহারা “দাস-ব্যবসায়ী” নামে পরিচিত। সে আপনাদের অভাবের প্রতি নজর রাখে এবং সন্তর্পণে ফাটকাবাজী দরে আপনাদের দাসকে কিনিতে আসে। অপারগ হইলে তাহার নিকট আপনারা আপনাদের দাসকে বিক্রয় করেন—অন্যথা বাড়ীর দরজা হইতে তাহাকে বিতাড়িত করেন। আপনারা তাহাকে ভয়ানকভাবে ঘৃণা করেন। তাহাকে বন্ধু, এমনকি সৎ-লোক বলিয়াও, মনে করেন না। আপনাদের সন্তানদের তাহার সন্তানদের সহিত খেলা করিতে দেন না; তাহারা ক্ষুদ্রকায় নিগ্রোদের সহিত স্মৃতি করিয়া বেড়াইতে পারে, কিন্তু “দাস-ব্যবসায়ীর” সন্তানের সহিত তাহাদের খেলা বন্ধ। তাহার সহিত যদি আপনাদের আদান-প্রদানের প্রয়োজন হয় আপনারা যথাসম্ভব তাহাকে স্পর্শ না করিয়া কাজ শেষ করিবার চেষ্টা করেন। সাক্ষাৎ হইলে সম্ভবতঃ আপনারা লোকদের সহিত করমর্দন করেন—কিন্তু দাস-ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে উহা এড়াইয়া যাইবার চেষ্টা করেন—তাহাদের সর্পিল স্পর্শ হইতে বাঁচিবার জন্য স্বতঃই আপনাদের শরীর কুঞ্চিত হইয়া আসে। যদি সে ধনবান হইয়া ব্যবসায় পরিত্যাগ করে, তথাপি আপনারা তাহার কথা স্মরণ রাখেন এবং তখনও তাহার ও তাহার পরিবারের সহিত সংস্রবের উপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখেন। কেন এরূপ করেন? যে ব্যক্তি শস্য, গরু অথবা তামাক বিক্রয় করে তাহার সহিত তো আপনারা এরূপ ব্যবহার করেন না।
অথচ দেখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কলম্বিয়া জেলাসহ সকল অঞ্চলে ৪৩৩,৬৪৩ জন স্বাধীন কৃষ্ণকায় ব্যক্তি রহিয়াছে। মাথাপিছু ৫০০ ডলার দরে তাহাদের মূল্য কুড়ি কোটি ডলার হইবে। এই বিপুল সম্পদ কীরূপে বেওয়ারিশ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে? ঘোড়া বা গরু-মহিষকে তো এরূপ স্বাধীনভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখা যায় না। কেন? এই কৃষ্ণকায় স্বাধীন ব্যক্তিরা নিজেরা, বা তাহাদের পূর্বপুরুষগণ, দাস ছিল; এবং তাহারা এখনও দাস থাকিয়া যাইত যদি না তাহাদের শ্বেতকায় স্বত্বাধিকারীদের উপর কোন একটি বিশেষ জিনিষ প্রভাব বিস্তার করিয়া, প্রচুর আর্থিক ক্ষতি সত্বেও, দাসদের মুক্তিদানে তাহাদিগকে অনুপ্রাণিত করিত। সেই বিশেষ জিনিষটি কি? এ বিষয়ে কি কোন ভ্রান্তি সম্ভব? এই সকল ক্ষেত্রেই আপনাদের ন্যায়বোধ এবং মানবিক সহানুভূতি আপনাদিগকে বলিয়াছে যে হতভাগ্য নিগ্রোরও নিজস্ব একটি সহজাত অধিকার রহিয়াছে, এবং যাহারা তাহা অস্বীকার করিয়া তাহাদিগকে সামান্য পণ্যদ্রব্যে পরিণত করে তাহাদের উপযুক্ত প্রাপ্য পদাঘাত, ঘৃণা এবং মৃত্যু।
তবে এখন কেন আপনারা আমাদিগকে দাসের মানবতা অস্বীকার করিয়া তাহাদিগকে শূকরের সমতুল্য করিয়া দেখিতে বলিতেছেন? আপনারা নিজেরা যাহা করিবেন না আমাদিগকে কেন তাহা করিতে বলিতেছেন? কুড়ি কোটি ডলারের লোভেও আপনারা যাহা করিতে সম্মত হ’ন নাই আমাদিগকে কেন তাহা নিরর্থক করিতে বলিতেছেন?
মিজুরি চুক্তি (Missouri Compromise) প্রত্যাহারের স্বপক্ষে প্রধান যুক্তি এখনও দেওয়া হয় নাই। সেই যুক্তি হইল “স্বায়ত্বশাসনের পবিত্র অধিকার।” মনে হয় সেনেটেও আমাদের মাননীয় সেনেটর তাঁহার প্রতিপক্ষীয়গণকে এই যুক্তির সদুত্তরদানে প্রবৃত্ত করিতে বিশেষ বেগ পাইয়াছেন। কোন কবি বলিয়াছেন,
আমার বিশ্বাস আমি স্বায়ত্বশাসনের অধিকার কি তাহা বুঝি এবং তাহার যথার্থ মূল্যও দিই। আমার ন্যায়বোধের মূলে রহিয়াছে এই প্রতিজ্ঞার প্রতি আমার বিশ্বাস যে, নিজস্ব ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তির আপন খুসীমত কাজ করিবার অধিকার রহিয়াছে। সমষ্টি এবং ব্যষ্টি, উভয় ক্ষেত্রেই আমি এই নীতি মানিয়া চলি। আমি এরূপ করি, কারণ তাহা রাজনৈতিক বিচারে সমীচীন এবং স্বভাবতঃই ন্যায্য; রাজনৈতিক দিক হইতে সমীচীন এই কারণে যে ইহা অনেক অনাবশ্যক কলহ নিবৃত্ত করে। এখানে অথবা ওয়াশিংটনে আমি কখনই ভার্জিনিয়ার ঝিনুক আইন অথবা ইণ্ডিয়ানার লালজাম (cranberry) আইন লইয়া মাথা ঘামাইব না।
স্বায়ত্বশাসনের অনুশাসন সঠিক নীতি—সর্বাত্মকভাবে এবং চিরকালের জন্য ইহা সঠিক; কিন্তু ইহার সঠিক প্রয়োগ হয় নাই। বরং আমার বলা উচিত যে উহার প্রয়োগ সঠিক হইয়াছে কিনা তাহা নির্ভর করে নিগ্রো মানুষ কি না সেই সিদ্ধান্তের উপর। যদি সে মানুষ না হয়, সেক্ষেত্রে কেন তবে, যে ব্যক্তি মানুষ সে তাহার সহিত স্বায়ত্তশাসনের নীতি অনুযায়ী খুসীমত ব্যবহার করিবে? কিন্তু যদি নিগ্রো মানুষই হয়, তবে সে নিজেকে পরিচালনা করিতে পারিবে না এ কথা বলা কি স্বায়ত্তশাসনের পূর্ণবিলোপেরই নামান্তর নহে? যখন শ্বেতকায় ব্যক্তি নিজেকে পরিচালনা করে—তখন তাহার নাম স্বায়ত্তশাসন; কিন্তু যখন সে নিজেকে পরিচালনা করিবার সঙ্গে সঙ্গে অপর একজনকেও শাসন করে তাহা তখন স্বায়ত্তশাসনের গণ্ডী ছাড়াইয়া যায়—তাহা স্বেচ্ছাচার। যদি নিগ্রো মানুষই হয় তবে দেশের সনাতন বিশ্বাসমত আমি তো জানি যে, “সকল মানুষ সমভাবে সৃষ্ট হইয়াছে” এবং অপরকে ক্রীতদাস করার কোন নৈতিক অধিকার কাহারও থাকিতে পারে না।
বিচারক ডগলাস আমাদের যুক্তিকে প্রায়ই তীব্র ব্যঙ্গ এবং বিদ্রূপ করিয়া বলেন : “নেব্রাস্কার শ্বেতকায় ব্যক্তিরা নিজেদের বিষয় পরিচালনায় পটু; কিন্তু মুষ্টিমেয় ঘৃণ্য নিগ্রোকে শাসন করিবার সামর্থ্য তাহাদের নাই।”
সত্যই আমি নিঃসন্দেহ যে অপরাপর স্থানের সাধারণ লোকদের ন্যায় নেব্রাস্কার জনসাধারণও সমান ক্ষমতার অধিকারী এবং তাহাদের সেই সক্ষমতা চিরকালই থাকিবে। আমি ইহার বিরুদ্ধে বলিতেছি না। আমার বক্তব্য এই যে কোন মানুষই অপরের সম্মতি ব্যতীত তাহাকে [অর্থাৎ সেই অপর লোককে] শাসন করিবার উপযুক্ত হইতে পারে না।
আমি বলিতেছি ইহাই হইল সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি—মার্কিন সাধারণতন্ত্রবাদের মূল ভিত্তি। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হইয়াছে :
“আমরা এই সত্যগুলিকে স্বতঃসিদ্ধ বলিয়া মনে করি : যে সকল মানুষই সমভাবে সৃষ্ট হইয়াছে; স্রষ্টা তাহাদিগকে কতকগুলি সহজাত অধিকার দ্বারা মণ্ডিত করিয়াছেন; সেই অধিকারগুলির মধ্যে রহিয়াছে জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখানুসরণের অধিকার। এই অধিকারগুলি সুরক্ষিত করিবার জন্য মানুষ সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং শাসিতদের সম্মতিই হইল সরকারের ন্যায্য ক্ষমতার ভিত্তি।”
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির উদ্দেশ্য ইহা দেখান যে আমাদের সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী সরকারের ন্যায্য ক্ষমতা আসে শাসিতদের সম্মতি হইতে। এখন প্রভু এবং দাসের সম্পর্ক, তদনুপাতে, এই নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রভু যে কেবল দাসের সম্মতি ছাড়াই তাহাকে শাসন করে তাহাই নহে; যে নিয়মাবলী দ্বারা সে নিজে পরিচালিত হয় দাসকে তাহা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের নীতি অনুযায়ী সে শাসন করে। সরকার পরিচালনায় সকল শাসিতকে সমান সুযোগ দিন, তবে তাহাই, কেবলমাত্র তাহাই, হইবে স্বায়ত্তশাসন।
যেন একথা বলা না হয় যে আমি শ্বেতকায় এবং কৃষ্ণকায়দিগের মধ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিবাদ করিতেছি। পূর্বেই আমি ইহা খণ্ডন করিয়াছি। কৃষ্ণকায়গণ আমাদের মধ্যে বর্তমান—এই সত্য হইতে উদ্ভূত প্রয়োজন বিষয়ক প্রশ্নের বিপক্ষে আমি সওয়াল করিতেছি না। আমি কেবল সেই তথাকথিত নৈতিক যুক্তির বিরোধিতা করিতেছি যাহার বলে নিগ্রোগণকে এমন এক অবস্থায় ফেলা হইবে যে অবস্থায় তাহারা কখনও ছিল না, আমি বিরোধিতা করিতেছি এমন একটি অন্যায় জিনিষের প্রসারের—যেখানে তাহা বর্তমান সেখানে বাধ্য হইয়াই আমাদিগকে সে বিষয়ে যথাসাধ্য ব্যবস্থা করিতে হইবে।
ভূমিকা
“আমরা এই স্থানে যাহা বলিতেছি পৃথিবীর জনসাধারণ তাহার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিবে না বা অধিককাল তাহা স্মরণেও রাখিবে না...”
১৮৬৩ সালের ১৯শে নভেম্বর পেনসিলভ্যানিয়ার অন্তর্গত গেটীসবার্গে এই ভাবেই গভীর বিনয়ের সহিত এব্রাহাম লিঙ্কন তাঁহার ভাষণ দিয়াছিলেন। ইহাই ছিল তাঁহার প্রকৃত বিশ্বাস। সেই বিশেষ স্থানে সেইমাত্র এক মহারণে মানুষ মৃত্যু বরণ করিয়াছে; সেই সমরই যেখানে গেটীসবার্গের নাম অক্ষয় করিয়া রাখিবে, সেখানে কি করিয়া আশা করা যায় যে জনসাধারণ তাঁহার কয়েকটি সামান্য কথা মনে করিয়া রাখিবেন?
কিন্তু লিঙ্কন এ ব্যাপারে ভুল করিয়াছিলেন। সেইদিন তিনি অনাড়ম্বরে যে কয়েকটি সহজ কথা বলিয়াছিলেন তাহা সত্যই দীর্ঘদিন যাবত স্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে; এবং যতদিন পর্যন্ত গেটীসবার্গ বক্তৃতায় সংক্ষেপে এবং সুষ্ঠভাবে প্রকাশিত আদর্শ জনসাধারণ পোষণ করিয়া চলিবেন ততদিন পর্যন্ত, চিরকালই, তাহা স্মরণীয় হইয়া থাকিবে।
তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি আরও যে সকল কথা বলিয়াছিলেন বা লিখিয়াছিলেন সেগুলিও যে “দীর্ঘদিন যাবত স্মরণীয় হইয়া থাকিবে” লিঙ্কন তাহা আশা করেন নাই—যেমন আশা করেন নাই গেটীসবার্গ বক্তৃতার ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর সর্বাপেক্ষা সঙ্কটজনক সময়ে প্রেসিডেন্টরূপে থাকিয়া লিঙ্কন অবশ্যই জানিতেন যে তিনি ইতিহাসে এক অধ্যায় রচনা করিতেছেন। তিনি তাঁহার উপর ন্যস্ত বিরাট দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তাই দেশবাসীর উদ্দেশে বাণী দানের সময় তিনি সযত্নে শব্দ চয়ন করিয়া ভাষণ রচনা করিতেন। তিনি যখন যেখানেই বক্তৃতা করিতেন সেখানকার নরনারীর মনকে তাহা স্পর্শ করিত।
যাহাতে তাঁহারা যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারেন এবং সেগুলি মানিয়া চলেন তজ্জন্য তিনি “জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের সরকার”-এর প্রধান কার্যনির্বাহক হিসাবে তিনি তাঁহার স্বদেশবাসীদিগকে প্রভাবিত করিতে চেষ্টা করিতেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি বক্তৃতা দিতেন এবং লিখিতেন। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নহে, সমগ্র বিশ্বেই আগামী কালের অসংখ্য নরনারী যে তাঁহার বাক্যাবলী পড়িবে, অনুশীলন করিবে এবং অনুধ্যান করিবে সেই ধারণা এই নিরহঙ্কার ব্যক্তির মনের কোন কোণে স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না—তিনি কয়েক বৎসর পূর্বে এক বন্ধুকে লিখিয়াছিলেন, “আমি অকপটে বলিতে বাধ্য যে আমি নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদের উপযুক্ত বলিয়া মনে করি না।”
শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েই নহে সমগ্র জীবন ব্যাপিয়া তিনি যাহা বলিয়াছেন বা লিখিয়াছেন প্রায় শতাব্দীকাল পূর্বে তাঁহার মৃত্যুর পর হইতে অদ্যাবধি সময় পর্যন্ত সে-সকলই সাগ্রহে সংগৃহীত হইয়া সযত্নে রক্ষিত হইয়াছে এবং প্রকাশিত ও পুনঃপ্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহার একজন বিখ্যাত জীবনীকার, কার্ল স্যান্ডবার্গের উক্তি অনুসারে লিঙ্কনের মুদ্রিত বক্তৃতা এবং রচনাবলীতে মোট ১,০৭৮,৩৬৫টি শব্দ আছে।
লিঙ্কনের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী সমারোহ উপলক্ষে মার্কিন জনসাধারণের অন্যতম মহান উত্তরাধিকার, শব্দ এবং চিন্তার এই মহামূল্য খনি হইতে নির্বাচিত অংশবিশেষ এই পুস্তিকায় সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।
লিঙ্কনের সম্পূর্ণ রচনাবলী সঙ্কলনের সম্পাদনায় খ্যাতিমান রয় পি. বেসলার-এর ভাষায় এগুলিতে প্রকাশিত হইয়াছে “মহান মন এবং হৃদয়ের মহিমা, যাহা নীতিতে ন্যায়পরায়ণতা, কার্যে সাধুতা এবং বাক্যে সৌন্দর্যের প্রত্যাশী। তাহাতে সৃষ্টিধর্মী চেতনা রূপ লাভ করিয়াছিল এবং তন্মধ্যেই ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার বাস্তবতা জীবন লাভ করিয়া অদ্যাপি প্রাণবন্ত রহিয়াছে। লিঙ্কন এই বাস্তবতার সহিত ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত; তাঁহার প্রকাশভঙ্গী অননুকরণীয়। তাঁহার কথাগুলি সেহেতু এখনও স্মরণীয় রহিয়াছে। তাঁহার যুগের তিনি সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি—আদর্শ পুরুষ। ফলে আমরা যখন তাঁহাকে অনুধাবন করিতে যাই তখন তাঁহাকে অতীত দিনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকারদের অপেক্ষা মহত্তর চরিত্ররূপে দেখি। সাধারণ নাগরিক এবং প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি যে সকল কাজ করিয়াছেন হয়ত কোন কালে সে সকলের বাস্তব তাৎপর্য ম্লান হইতে পারে; কিন্তু যে ভাস্বর আত্মা তাঁহার কথাগুলিকে উদ্ভাসিত করিয়া রাখিয়াছে, আমাদের তাঁহাকে বিস্মৃত হইলে চলিবে না, এবং তাঁহার মহত্ত্বকেও স্বীকার করিতে হইবে।”
দ্রষ্টব্য মিঃ রয় পি. বেসলারের উক্ত উদ্ধৃতিটি এব্রাহাম লিঙ্কন তাঁহার বক্তৃতা ও রচনাবলী। মিঃ বেসলার সম্পাদিত এবং দি ওয়ার্লড্ পাবলিশিং কোং কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তক হইতে তাঁহাদের অনুমতিক্রমে গৃহীত।
১৮৬৩ সালের ১৯শে নভেম্বর পেনসিলভ্যানিয়ার অন্তর্গত গেটীসবার্গে এই ভাবেই গভীর বিনয়ের সহিত এব্রাহাম লিঙ্কন তাঁহার ভাষণ দিয়াছিলেন। ইহাই ছিল তাঁহার প্রকৃত বিশ্বাস। সেই বিশেষ স্থানে সেইমাত্র এক মহারণে মানুষ মৃত্যু বরণ করিয়াছে; সেই সমরই যেখানে গেটীসবার্গের নাম অক্ষয় করিয়া রাখিবে, সেখানে কি করিয়া আশা করা যায় যে জনসাধারণ তাঁহার কয়েকটি সামান্য কথা মনে করিয়া রাখিবেন?
কিন্তু লিঙ্কন এ ব্যাপারে ভুল করিয়াছিলেন। সেইদিন তিনি অনাড়ম্বরে যে কয়েকটি সহজ কথা বলিয়াছিলেন তাহা সত্যই দীর্ঘদিন যাবত স্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে; এবং যতদিন পর্যন্ত গেটীসবার্গ বক্তৃতায় সংক্ষেপে এবং সুষ্ঠভাবে প্রকাশিত আদর্শ জনসাধারণ পোষণ করিয়া চলিবেন ততদিন পর্যন্ত, চিরকালই, তাহা স্মরণীয় হইয়া থাকিবে।
তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি আরও যে সকল কথা বলিয়াছিলেন বা লিখিয়াছিলেন সেগুলিও যে “দীর্ঘদিন যাবত স্মরণীয় হইয়া থাকিবে” লিঙ্কন তাহা আশা করেন নাই—যেমন আশা করেন নাই গেটীসবার্গ বক্তৃতার ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর সর্বাপেক্ষা সঙ্কটজনক সময়ে প্রেসিডেন্টরূপে থাকিয়া লিঙ্কন অবশ্যই জানিতেন যে তিনি ইতিহাসে এক অধ্যায় রচনা করিতেছেন। তিনি তাঁহার উপর ন্যস্ত বিরাট দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তাই দেশবাসীর উদ্দেশে বাণী দানের সময় তিনি সযত্নে শব্দ চয়ন করিয়া ভাষণ রচনা করিতেন। তিনি যখন যেখানেই বক্তৃতা করিতেন সেখানকার নরনারীর মনকে তাহা স্পর্শ করিত।
যাহাতে তাঁহারা যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারেন এবং সেগুলি মানিয়া চলেন তজ্জন্য তিনি “জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের সরকার”-এর প্রধান কার্যনির্বাহক হিসাবে তিনি তাঁহার স্বদেশবাসীদিগকে প্রভাবিত করিতে চেষ্টা করিতেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি বক্তৃতা দিতেন এবং লিখিতেন। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নহে, সমগ্র বিশ্বেই আগামী কালের অসংখ্য নরনারী যে তাঁহার বাক্যাবলী পড়িবে, অনুশীলন করিবে এবং অনুধ্যান করিবে সেই ধারণা এই নিরহঙ্কার ব্যক্তির মনের কোন কোণে স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না—তিনি কয়েক বৎসর পূর্বে এক বন্ধুকে লিখিয়াছিলেন, “আমি অকপটে বলিতে বাধ্য যে আমি নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদের উপযুক্ত বলিয়া মনে করি না।”
শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েই নহে সমগ্র জীবন ব্যাপিয়া তিনি যাহা বলিয়াছেন বা লিখিয়াছেন প্রায় শতাব্দীকাল পূর্বে তাঁহার মৃত্যুর পর হইতে অদ্যাবধি সময় পর্যন্ত সে-সকলই সাগ্রহে সংগৃহীত হইয়া সযত্নে রক্ষিত হইয়াছে এবং প্রকাশিত ও পুনঃপ্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহার একজন বিখ্যাত জীবনীকার, কার্ল স্যান্ডবার্গের উক্তি অনুসারে লিঙ্কনের মুদ্রিত বক্তৃতা এবং রচনাবলীতে মোট ১,০৭৮,৩৬৫টি শব্দ আছে।
লিঙ্কনের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী সমারোহ উপলক্ষে মার্কিন জনসাধারণের অন্যতম মহান উত্তরাধিকার, শব্দ এবং চিন্তার এই মহামূল্য খনি হইতে নির্বাচিত অংশবিশেষ এই পুস্তিকায় সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।
লিঙ্কনের সম্পূর্ণ রচনাবলী সঙ্কলনের সম্পাদনায় খ্যাতিমান রয় পি. বেসলার-এর ভাষায় এগুলিতে প্রকাশিত হইয়াছে “মহান মন এবং হৃদয়ের মহিমা, যাহা নীতিতে ন্যায়পরায়ণতা, কার্যে সাধুতা এবং বাক্যে সৌন্দর্যের প্রত্যাশী। তাহাতে সৃষ্টিধর্মী চেতনা রূপ লাভ করিয়াছিল এবং তন্মধ্যেই ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার বাস্তবতা জীবন লাভ করিয়া অদ্যাপি প্রাণবন্ত রহিয়াছে। লিঙ্কন এই বাস্তবতার সহিত ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত; তাঁহার প্রকাশভঙ্গী অননুকরণীয়। তাঁহার কথাগুলি সেহেতু এখনও স্মরণীয় রহিয়াছে। তাঁহার যুগের তিনি সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি—আদর্শ পুরুষ। ফলে আমরা যখন তাঁহাকে অনুধাবন করিতে যাই তখন তাঁহাকে অতীত দিনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকারদের অপেক্ষা মহত্তর চরিত্ররূপে দেখি। সাধারণ নাগরিক এবং প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি যে সকল কাজ করিয়াছেন হয়ত কোন কালে সে সকলের বাস্তব তাৎপর্য ম্লান হইতে পারে; কিন্তু যে ভাস্বর আত্মা তাঁহার কথাগুলিকে উদ্ভাসিত করিয়া রাখিয়াছে, আমাদের তাঁহাকে বিস্মৃত হইলে চলিবে না, এবং তাঁহার মহত্ত্বকেও স্বীকার করিতে হইবে।”
দ্রষ্টব্য মিঃ রয় পি. বেসলারের উক্ত উদ্ধৃতিটি এব্রাহাম লিঙ্কন তাঁহার বক্তৃতা ও রচনাবলী। মিঃ বেসলার সম্পাদিত এবং দি ওয়ার্লড্ পাবলিশিং কোং কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তক হইতে তাঁহাদের অনুমতিক্রমে গৃহীত।
Post a Comment