প্রকাশনা তথ্য
প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ
এপ্রিল ২০২৩, চৈত্র ১৪২৯
প্রচ্ছদ
প্রকাশক
সুনীল আকাশ আত্মপ্রকাশ কেন্দ্র (SAAP) প্রকাশনা,
1215-40, Gordonridge Place,
Scarborough, Ontario : M1K 4H8, Canada.
প্রকাশকের কথা
“নয়া চীনের গল্পসংকলন’ পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করার মূল উদ্দেশ্য হলো বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে চীনের কথাসাহিত্য যে অগ্রগতি লাভ করেছে তার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটানো।
পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশক পর্যন্ত তিনটি খণ্ডে এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আরেকটি খণ্ডে মোট তিরিশটি গল্প এই সংকলনে প্রকাশিত হবে। এই সব গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে নয়া চীনের নয়া সমাজ, সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনে ও আধুনিকীকরণে শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং চীনের বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রয়াস এবং আদর্শগত সংগ্রাম। তাছাড়া আছে জাপ-আক্রমণ প্রতিরোধ যুদ্ধে ও বিপ্লবী সংগ্রামে চীনা যুবক-যুবতীদের আত্মবিসর্জনের কাহিনী, এবং বীর যোদ্ধাদের গুণগান।
কয়েক হাজার গল্পের মধ্যে থেকে ডজন তিনেক উৎকৃষ্ট বা সেরা গল্প বাছাই করা খুব সহজ কাজ নয়, আর অগণিত নতুন লেখকদের মধ্যে কাকে রেখে কাকে বাদ দেয়া যায় সেই প্রশ্নটিও খুব জটিল। কাজেই, আমাদের সংকলিত এই গল্পগুলিই যে আজ পর্যন্ত নয়া চীনের একমাত্র সেরা গল্প এবং এর সব কটি গল্পই শিল্পরীতি ও ভাষার দিক থেকে উন্নতমানের সে দাবী আমরা করব না। গল্পগুলি নির্বাচনে আমরা বিষয়বস্তুর প্রতিই দৃষ্টি দিয়েছি বেশী। তাছাড়া, নয়া চীনের প্রখ্যাত গল্পকার ও ঔপন্যাসিক যেমন চাও শুলি, চাং সিয়ানলিয়াং, ফং চিছাই, তং ইয়ৌমেই, মা ফং, খাং চুও, হাও রান ইত্যাদির রচনা আমাদের এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর কারণ, আমরা ভবিষ্যতে পৃথক পৃথকভাবে অথবা একসঙ্গে এঁদের গল্প-সংকলন প্রকাশ করবার ইচ্ছা রাখি।
বর্তমান খণ্ডে, ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে রচিত সাতটি গল্প সংকলিত হয়েছে।
এই সংকলনের জন্যে অনুবাদক সেন নালান যত্নসহকারে একটি ভূমিকা লিখেছেন। এই ভূমিকাটি পড়ে পাঠকেরা নয়া চীনের গল্প উপন্যাসের বিকাশের ধারা সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাবেন।
পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশক পর্যন্ত তিনটি খণ্ডে এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আরেকটি খণ্ডে মোট তিরিশটি গল্প এই সংকলনে প্রকাশিত হবে। এই সব গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে নয়া চীনের নয়া সমাজ, সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনে ও আধুনিকীকরণে শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং চীনের বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রয়াস এবং আদর্শগত সংগ্রাম। তাছাড়া আছে জাপ-আক্রমণ প্রতিরোধ যুদ্ধে ও বিপ্লবী সংগ্রামে চীনা যুবক-যুবতীদের আত্মবিসর্জনের কাহিনী, এবং বীর যোদ্ধাদের গুণগান।
কয়েক হাজার গল্পের মধ্যে থেকে ডজন তিনেক উৎকৃষ্ট বা সেরা গল্প বাছাই করা খুব সহজ কাজ নয়, আর অগণিত নতুন লেখকদের মধ্যে কাকে রেখে কাকে বাদ দেয়া যায় সেই প্রশ্নটিও খুব জটিল। কাজেই, আমাদের সংকলিত এই গল্পগুলিই যে আজ পর্যন্ত নয়া চীনের একমাত্র সেরা গল্প এবং এর সব কটি গল্পই শিল্পরীতি ও ভাষার দিক থেকে উন্নতমানের সে দাবী আমরা করব না। গল্পগুলি নির্বাচনে আমরা বিষয়বস্তুর প্রতিই দৃষ্টি দিয়েছি বেশী। তাছাড়া, নয়া চীনের প্রখ্যাত গল্পকার ও ঔপন্যাসিক যেমন চাও শুলি, চাং সিয়ানলিয়াং, ফং চিছাই, তং ইয়ৌমেই, মা ফং, খাং চুও, হাও রান ইত্যাদির রচনা আমাদের এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর কারণ, আমরা ভবিষ্যতে পৃথক পৃথকভাবে অথবা একসঙ্গে এঁদের গল্প-সংকলন প্রকাশ করবার ইচ্ছা রাখি।
বর্তমান খণ্ডে, ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে রচিত সাতটি গল্প সংকলিত হয়েছে।
এই সংকলনের জন্যে অনুবাদক সেন নালান যত্নসহকারে একটি ভূমিকা লিখেছেন। এই ভূমিকাটি পড়ে পাঠকেরা নয়া চীনের গল্প উপন্যাসের বিকাশের ধারা সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাবেন।
ভূমিকা
১৯৪২ সালের মে মাসে, ইয়ানআন-এ সাহিত্য ও শিল্পকলা সম্পর্কে এক আলোচনা সভায় চেয়ারম্যান মাও জেতুং বলেছিলেন, “আমাদের শিল্প-সাহিত্য মূলতঃ শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের জন্য।” এই উপলব্ধিকে আশ্রয় করেই শুরু হয় নয়া চীনের নয়া সাহিত্যের অগ্রযাত্রা।
১৯১৯ সালের ‘৪ঠা মে আন্দোলন’ আধুনিক চীনা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব এনেছিল তা ছিল নয়া গণতন্ত্র পর্যায়ের বিপ্লবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তখনকার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনোভাব। আর বহু লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজতন্ত্রের চিন্তাও প্রকাশ পায়। বিপ্লবে সাফল্য অর্জন করে ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনের সর্বহারাশ্রেণী প্রতিষ্ঠিত করল নিজেদের রাষ্ট্র। নির্যাতিত নিষ্পেষিত জনগণ হলো রাষ্ট্রের মালিক। রাষ্ট্রের চরিত্র গেল পাল্টে। সেই সঙ্গে চীনা সমাজেও এল আমূল পরিবর্তন। হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা সামন্ততন্ত্রের জঞ্জাল পুড়িয়ে ফেলে শুরু হলো নতুন সমাজ গঠনের মহান ব্রত, আর সেই সমাজের নায়ক হলো একদা অনাহারী, অর্ধভুক্ত জমিহারা, হালছাড়া কোটি কোটি কৃষক ও শোষিত শ্রমিক। তাই, স্বাভাবিকভাবে এরাই হলো নয়া সাহিত্যের মুখ্য নায়ক। আগেকার সাহিত্যে শুধু সমাজের “সাহেব-বিবিদের” বিলাসপূর্ণ জীবন প্রতিফলনের স্থলে “গোলামদের” আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা প্রতিফলিত হতে থাকল। সমাজতন্ত্রের পর্যায় পেরিয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য সমাজব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসতে থাকে তাতে সাহিত্যও চরিত্র ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক হয়ে ওঠে যার প্রাণ হলো সাম্যবাদ চিন্তাধারা।
১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে, চীনের শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় স্থির হয় যে, নয়া চীনের সকল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকাজের প্রথম লক্ষ্য হবে শ্রমিক কৃষক সৈনিকদের সেবা করার যে প্রস্তাব মাও জেতুং সাত বছর আগে ইয়ানআনে দিয়েছিলেন। শিল্প-সাহিত্য যে রাজনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক ব্রতেরও সেবা করবে সে-কথাও মাও জেতুং তখন বলেন। কিন্তু পরে এই নীতি বাস্তব প্রয়োগের সময় অনেক শিল্পী ও সাহিত্যিক তথাকথিত রাজনীতি ও সমাজতন্ত্রের সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন।
১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে বলা হয় যে, ব্যাপক ও জ্বালামুখী শ্রেণীসংগ্রাম মূলতঃ শেষ হয়েছে এবং আগামী দিনের মুখ্য দায়িত্ব হবে সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ সাধন। শ্রেণী-সম্পর্ক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং নতুন দায়িত্ব পালনের তাগিদে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সেবা করার পরিধি, লক্ষ্যবস্তু আর বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন এল।
১৯৬২ সালের ২৩ মে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র “রেনমিন রিপাও”, “বৃহত্তর জনগণের সেবা করুন” শীর্ষক এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত করে। এতে বলা হয় যে, শিল্প ও সাহিত্য চীনের সব জাতিসত্তার শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য মেহনতী জনগণ, সব গণতান্ত্রিক পার্টি ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবিশেষ, স্বদেশভক্ত জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী, দেশহিতব্রতী প্রবাসী চীনা ও সকল স্বদেশভক্ত ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এবং শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক প্রাধান্য ব্যাপক জনগণের সেবা করবে ও তাদেরই হিতকার্যে নিয়োজিত থাকবে। এতে আরো বলা হয় যে, শিল্প ও সাহিত্য শ্রমিকশ্রেণীর প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যতদূর সম্ভব সমাজের ব্যাপক স্তরের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, আর সকলকার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য সারা দেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই নীতি এবং ইতোপূর্বে মাও জেতুং উত্থাপিত “শত ফুল বিকশিত হোক ও শত মতবাদ বিরাজ করুক” চীনের তৎকালীন সমাজ-অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও নয়া চীনের সাহিত্য উদ্যানে শত ফুলের সমারোহ অচিরেই অন্তর্হিত হলো। ১৯৬৬ সাল থেকে “সংশোধনবাদী সাহিত্য’র বিরোধিতার নামে সাহিত্যের মানদণ্ড হিসেবে রাজনীতিই হলো মুখ্য আর মাও জেতুং উত্থাপিত অন্যান্য মানদণ্ড হলো পরিত্যক্ত। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম ও “বামঝোঁকের” ফলে উদ্ভূত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলল দীর্ঘ দশ বছর।
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, শিল্প ও সাহিত্য জনগণ ও সমাজতন্ত্রের সেবা করবে। এই উপলব্ধি মাও জেতুং-এর শিল্প ও সাহিত্য চিন্তাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
নয়া চীনের সমাজতন্ত্র বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাহিত্যের বিশেষত্ব মনে রেখে আমরা তার নয়া সাহিত্যের অগ্রগতিকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।
এক, উদ্যোগপর্বের অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরকালীন নয়া সাহিত্যের জন্ম ও অগ্রগতির পর্যায়—১৯৪৯ থেকে ১৯৬৬। এই সময়পর্ব হলো পুরনো ধ্যান-ধারণা ও সামন্তবাদের অবশিষ্ট ও অবক্ষয়ী ভাবধারাকে বিদায় দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ও নতুন ভাবধারা কায়েম করার এবং সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের পর্ব। এই পর্বে চীনের জাতীয় অর্থনীতিকে দ্রুত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সুপরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক গঠনকাজ চালানো হয়, দেশের বেশির ভাগ এলাকায় উৎপাদন-উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটিয়ে নয়া গণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হয়। তাই, এই পর্বে সৃষ্ট সাহিত্যে আমরা দেখতে পাই বিপ্লবী সংগ্রামের চিত্র, সমাজতান্ত্রিক মনোভাব এবং সাম্যবাদ চিন্তাধারায় স্নাত নতুন মানুষ, নতুন ঘটনা এবং শ্রেণীসংগ্রামের এক জাজ্বল্য চিত্র।
দুই, ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ পর্যায়ের সাহিত্য—১৯৬৬-১৯৭৬। এই সময়পর্বে চীনের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে তুলকালামের সৃষ্টি হয় তার মূলে ছিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব। এ-সম্পর্কে বলা হয়েছে: “ইতিহাস স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভ্রান্ত অনুধাবনের বশবর্তী অবস্থায় একজন নেতা কর্তৃক সূচিত এবং প্রতিবিপ্লবী চক্র কর্তৃক আত্মস্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহৃত ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ অভ্যন্তরীণ গোলযোগে পর্যবসিত হয়েছিল এবং পার্টি, রাষ্ট্র ও সমগ্র জনগণের জন্য এনেছিল মহাবিপর্যয়।” (দ্রষ্টব্য : চীনের দলিল: চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর পার্টির ইতিহাসের কতকগুলো প্রশ্ন সম্পর্কে প্রস্তাব (১৯৪৯-১৯৮১), বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পেইচিং, ১৯৮১, পৃ: 88)।
এই সময়পর্বে চীনের অর্থনৈতিক গঠনকাজে যেমন ছিল ব্যর্থতার দিক তেমনি ছিল এক বিরাট সাফল্যের দিক। সাহিত্য ক্ষেত্রেও অনুরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব দেখা যায়। শিল্প ও সাহিত্যের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য আট-দফা নীতি গৃহীত হলে অবস্থার কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবার আগেই শুরু হয় শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে “সংশোধনবাদ বিরোধী ও সংশোধনবাদ প্রতিরোধ” সংগ্রাম। শুরু হলো কয়েকখানি উপন্যাস, নাটক, পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাহিত্যিক মহলে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত সমালোচনা ও বিষোদ্গার। সাধারণ এবং স্বাভাবিক সমালোচনার গণ্ডী ছাড়িয়ে তাঁদের প্রতি আক্রমণ শ্রেণী-সংগ্রামের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যেমন ১৯৫৯ সালে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সুসাহিত্যিক উহান রচিত “হাইরুই-এর পদচ্যুতি” নামক নাটকটি ১৯৬৫ সালে তীব্র সমালোচনার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং তাতেই সূচিত হয় ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’।
তিন, ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবোত্তর’ পর্যায়—১৯৭৭ সাল থেকে শুরু। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লিন পিয়াও চীনের রাজনীতি এবং পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকাংশ ক্ষমতা চিয়াং ছিং, ওয়াং হোংওয়েন, চাং ছুনছিয়াও এবং ইয়াও ওয়েনইউয়ান-এর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা জনগণের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও জেতুং-এর তিরোধান হয়। বৃহত্তর জনগণের সমর্থন না থাকায় চিয়াং ছিং চক্রের পতন ঘটে অক্টোবর মাসে। এই পতনের পর থেকে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে এক নতুন যুগ।
আগেই বলা হয়েছে, নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর চীনা সমাজে যে যুগসৃষ্টিকারী পরিবর্তন আসতে থাকে তা সাহিত্যিকদের জন্য উন্মুক্ত করে এক সীমাহীন দিগন্ত। নতুন নতুন চরিত্র, নতুন নতুন ঘটনা সাহিত্যিকদের সামনে হাজির করে অফুরন্ত উপাদান। তাই, নয়া চীনের প্রথম তিরিশ বছরের গল্প-উপন্যাস বাস্তব জীবনের ব্যাপকতা ও গভীরতা প্রতিফলনে এবং রচনার গুণগত ও সংখ্যাগত দিক থেকে ১৯১৯-এর ৪ঠা মে আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৯-এর মুক্তি পর্যন্ত তিরিশ বছরের সাহিত্যকে ছাড়িয়ে যায়, এবং বিরাট অগ্রগতি লাভ করে। মুক্তির প্রথম সতের বছরের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজ-জীবনের পরিবর্তনের সাথে সাথে এবং সাহিত্য বিকাশের নিজস্ব নিয়মেই প্রতিটি পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য সাহিত্যেও পরিস্ফুট হয়েছে। দেশের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আবর্তন-বিবর্তন অগ্রগতির ছবি গল্পকারেরা তাঁদের গল্পে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন।
১৯৫০-এর পরবর্তী দু-তিন বছর গল্পে, নভেলা ও উপন্যাসে চীনের মুক্তি সংগ্রাম এবং জাপ-প্রতিরোধ যুদ্ধই প্রতিফলিত হয়েছে বেশী। লিউ পাইইয়ু হলেন একজন সার্থক লেখক যিনি নয়া চীন প্রতিষ্ঠার শুরুতেই চীনের ইতিহাসের এই অধ্যায়টি সাহিত্যের রূপের মাধ্যমে অক্ষয় করে রেখেছেন। তাঁর রচিত “অগ্নিশিখার সামনে” নামক কাহিনীতে হুপেই প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে একটি নদী পার হবার সময় মুক্তিফৌজের সৈনিকেরা যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন তা বর্ণিত হয়েছে। লেখক মা চিয়া’র “যে ফুল কখনো শুকাবে না” নামক কাহিনীতে এক বিপ্লবী সৈনিকের আত্মত্যাগের আদর্শ ও সংখ্যালঘু জাতির প্রতি কমিউনিস্ট পার্টির নীতি বন্দিত হয়েছে। খোং চ্যুয়ে এবং ইউয়ান চিং লিখিত “নতুন বীর ছেলে-মেয়েদের উপাখ্যান” নামক কাহিনীতে জাপ-প্রতিরোধ যুদ্ধে চীনের যুবক-যুবতীরা যে আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমিকের দৃষ্টান্ত স্থাপিত করেছিল সেই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ছেন তেংখে তাঁর “জীবন্ত মানুষের দেয়াল” নামক কাহিনীতে চীনের মুক্তি সংগ্রামের এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। একই বিষয়বস্তু নিয়ে “ব্রোঞ্জের দেয়াল” নামে একটি নভেলা লিখেছেন প্রসিদ্ধ লেখক লিউ ছিং।
নয়া চীন প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র কোরিয়া আমেরিকার আক্রমণের শিকার হলে এবং চীনের ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব বিপদের সম্মুখীন হলে চীন দেশের দিকে দিকে “আমেরিকার প্রতিরোধ করো, কোরিয়াকে সাহায্য করো” ধ্বনি সোচ্চার হয়ে ওঠে। তখন অগণিত চীনা যুবক-যুবতী এবং প্রবীণ বিপ্লবী ও যোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবকরূপে কোরিয়াবাসীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকে আত্মবিসর্জন দেন। তাঁদের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কাহিনী এবং প্রগাঢ় আন্তর্জাতিকতাবাদ চীনা সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে চির-অমর করে রেখেছেন। ইয়াং শুও’র “তিন হাজার লি বিস্তৃত নদী ও পাহাড়” এবং লু চুকুও-এর “শাংকানলিং পাহাড়ে” নামক কাহিনী দুটি পাঠকদের মনে গভীরভাবে সাড়া জাগায়। লু লিং-এর “জলাভূমিতে যুদ্ধাভিযান” কাহিনীটিতেও কোরিয়া রণক্ষেত্রে চীনা সংগ্রামীদের জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।
মুক্তির পরই গ্রামীণ চীনে সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করে সমাজবাদী সমাজ গঠনের আন্দোলন শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকে গ্রামীণ চীনের পটভূমিতে যে সব কাহিনী সৃষ্টি হয় তার মধ্যে বিখ্যাত হলো চাও শুলি’র “রেজিষ্ট্রেশন”, কু ইয়ু-এর “নতুন ঘটনা নতুন ব্যবস্থা”, মা ফং-এর “বিবাহ” ও “ধুনকল”, কাও সিয়াওসেং-এর “অঙ্গীকার” কাহিনীগুলোর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সব কাহিনীর অধিকাংশেই গ্রামের সামন্তবাদী সমাজের পারিবারিক ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিবাহ প্রথা ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
১৯৫৩ সালে চীন জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ সম্পন্ন করে সমাজ সংস্কার ও সমাজতন্ত্র গঠনের পর্যায়ে পা দিল। উৎপাদন সম্পর্কের বিরাট পরিবর্তন চীনের সমাজ-জীবনেও এনে দেয় আমূল পরিবর্তন। তাই এই সময়কার গল্প-উপন্যাসেও আমরা এক নতুন রূপ দেখতে পাই।
প্রথমতঃ, ভূমি সংস্কার এবং কৃষি সমবায় কৃষকদের জীবনে পরিবর্তন আনতে থাকে আর সেই সঙ্গে কিছু দ্বন্দ্বেরও আবির্ভাব হতে থাকে। এমন এক দ্বন্দ্বের ছবি তুলে ধরেছেন লি চুন তাঁর “ওই পথ নয়” গল্পে। চাও শুলি-ও তাঁর “সানলি ওয়ান” নামক কাহিনীতে কৃষি সমবায় বাস্তবায়িত করবার সময় চীনের গ্রামে যে জটিল সংগ্রাম চলে তা প্রতিফলিত করেছেন। এরূপ বিষয়বস্তু নিয়ে ঔ ইয়াংশান লিখেছেন “উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ”, ওয়াং সিচিয়ান লিখেছেন “বসন্ত আহ্বানের গান”, লিউ শুতে লিখেছেন “সেতু”। তখনকার গ্রামের জনজীবন নিয়ে খাং চুও লিখেছেন “বসন্তে রোপণ শরতের ফসল”, ছিন চাওইয়াং লিখেছেন “গ্রামের কথা”। নতুন জীবনের সাথে সাথে জনগণের চিন্তাজগতেও যে পরিবর্তন আসতে থাকে সে-ই কাহিনীই ফুটে উঠেছে তাঁদের এই দুটি গল্পে। লিউ শাওথাং-এর “নতুন ডাল সবুজ পাতা”, লুও পিনচি-এর “রাত্রে হলুদ মাটির ঢিবি পার”ও এই বিষয়বস্তু নিয়ে লিখিত হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ, বিপ্লবী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে রচিত কাহিনীরও আবির্ভাব হতে থাকে এই সময়ে। এই ধরনের গল্প-কাহিনীর মধ্যে চুন ছিং-এর “নদীর পাড়ে ঊষার উদয়” এবং ওয়াং ইউয়ানচিয়ান-এর “পার্টি সভ্যপদের চাঁদা” কে প্রতিনিধিত্বমূলক রচনা বলে গণ্য করা যেতে পারে। “নদীর পাড়ে ঊষার উদয়” গল্পের সিয়াও ছেন ও তার পরিবারের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের দৃশ্য এবং “পার্টি সভ্যপদের চাঁদা” গল্পের হুয়াং সিন-এর বিপ্লবের জন্য আত্মবিসর্জনের আদর্শ সবাইকে অনুপ্রাণিত করে ও পাঠকদের চিত্তে গভীর দাগ কাটে। মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিতে লিখিত দীর্ঘ উপন্যাসগুলোর মধ্যে আছে তু ফেংছেং রচিত “ইয়ানআনকে রক্ষা করো”, সুন লি রচিত “ঝড়ের বছরগুলি”, কাও ইয়ুলান রচিত “ছোট শহরের ইতিবৃত্ত”।
উপরোক্ত দুটি বৈশিষ্ট্য ছাড়া এই সময়কার সাহিত্যের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো যে, জীবনের নানা দিক গল্প-উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। ছাও মিং-এর “রেল ইঞ্জিন”, পাই লাং-এর “ভবিষ্যৎ সুখের জন্য”, চৌ লিপো’র “গলিত লৌহস্রোত”, লেই চিয়া-এর “ইয়ালু নদীর পাড়ে এলো বসন্ত” ইত্যাদি রচনায় লেখকেরা শ্রমিকদের জীবন বর্ণনায় তাদের শুধু কারখানা ও যন্ত্রপাতির মধ্যেই আবদ্ধ না রেখে তাদের ঘরোয়া জীবনকেও স্থান দিলেন। শ্রমিকদের জীবন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় বা ইতোপূর্বে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে সাহিত্যও খুব বেশী না থাকায় এই সব লেখক শ্রমিকদের জীবনের গভীরে যেতে পারেন নি। আর তাঁদের চরিত্রসৃষ্টিতেও বলিষ্ঠতার অভাব দেখা যায়। তবে, নয়া চীন প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরই উৎপাদন পুনরুদ্ধার আর বৃদ্ধির ফলে শ্রমিকদের একদা অশান্তির জীবনে যে পরিবর্তন আসতে থাকে তা যথাসম্ভব দ্রুত সাহিত্যে প্রতিফলনে এই সব লেখকের অবদান অনস্বীকার্য।
একই সময়ে, চীনের অন্যান্য জাতিসত্তার লোকেদের—যাদের এক সময় হেয় করা হতো—জীবন নিয়ে গল্প-উপন্যাস সৃষ্টি হতে থাকে; আর সবচেয়ে বড় কথা তাদেরই মধ্য থেকে আবির্ভাব হতে থাকে নতুন নতুন লেখকের। এই সব জাতির লেখকেরা নিজ নিজ জাতির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনযাত্রা, নতুন সমাজব্যবস্থায় তাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি আর তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে, বিশেষ করে সংখ্যাগুরু হান-জাতির সঙ্গে ঐক্য স্থাপনার প্রচেষ্টা ফুটিয়ে তুললেন তাঁদের রচনায়। মুক্তির অনতিকাল পরই প্রকাশিত মালছিন হু’র “খোরছিন তৃণভূমির মানুষ”, ফেং সিখো’র “সোনালী সিংলিং গিরিশিখর”, লি ছিয়াও-এর “উচ্ছলিত চিনশা নদী” এই বিষয়বস্তু নিয়ে সার্থক ও তাৎপর্যপূর্ণ রচনা।
এই সময়পর্বে নয়া চীনের কিশোর ও শিশু সাহিত্যও বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। নয়া সমাজের ছোটদের স্বদেশচেতনা ও বুদ্ধিবিকাশ এবং নিয়মানুবর্তিতা ও সমবয়সীদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার শিক্ষা দেয় এই সব গল্প। চাং থিয়ানয়ি তাঁর “লুও ওয়েনই-এর কাহিনী” চিন্তা এবং শিল্পরীতির দিক থেকে সাফল্য অর্জন করে এবং কিশোরদের মনে গভীর দাগ কাটে। ইয়ান ওয়েনচিং, ইউয়ান চিং, হু ছি, হো য়ি, চিন চিন ইত্যাদি লেখকদের রচনাও শিক্ষামূলক ও কিশোরদের মন কেড়ে নেয়।
সৈনিক জীবন নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টিও এই সময়পর্বে ব্যাপকতা লাভ করে। ইতোপূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের সংগ্রামী জীবনকেই কেন্দ্র করে রচিত হত নানা কাহিনী। এই পর্বে দেশ গড়া ও উৎপাদন কাজের সঙ্গেও তাদের একাত্ম হয়ে যাবার কাহিনীও সাহিত্যে প্রতিফলিত হতে থাকে। শি ইয়ের “থিয়ানশান পর্বতের ওপর উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ” এই বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত একটি সার্থক উপন্যাস।
চীনের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জীবন নিয়ে রচিত গল্প-উপন্যাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। হানজাতিভুক্ত লেখকেরা এবিষয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এই সব লেখকের অধিকাংশই সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাস করে এই জাতিসত্তাসমূহের জীবন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করে তবেই লিখতে পেরেছেন বাস্তবধর্মী বহু গল্প ও উপন্যাস। এতে চীনা সাহিত্যের একটি শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব হয়। আলোচ্যপর্বে, লু তি’র “মনোরম দক্ষিণ প্রান্ত”, লিন ইয়ু-এর “সীমান্তের আলোকসঙ্কেত” এবং কুও কুওফু’র “আমেং উপজাতিদের মধ্যে” কাহিনীগুলোতে যথাক্রমে থুং জাতিসত্তার এবং কাওয়া জাতিসত্তার সামন্ততান্ত্রিক অবশিষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্যু হুয়াইচোং-এর “আমরা রোপণ করি প্রেমের বীজ” কাহিনীটিতে তিব্বতি জাতিসত্তার লোকেদের নতুন জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।
এই সময়পর্বে বুদ্ধিজীবীদের জীবন নিয়ে যে উপন্যাসটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে তা হলো হান শুই-এর “বীরের মতো এগিয়ে যাও”। এই উপন্যাসটি চিন্তা ও শিল্পরীতিতে খুব উন্নত না হলেও লেখক এতে এক নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছেন।
এই সময়পর্বে ছোটগল্পেরও আবির্ভাব হয় বেশী। নব উদিত লেখকদের মধ্যে অনেকেই দু’একটি গল্প লিখেই সাহিত্যিকদের মধ্যে স্থান করে নেন। শুধু বিষয়বস্তু চয়নে নয় ভাষা ও শিল্পরীতির দিক থেকেও তাঁরা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেন। লি চুন-এর “ওই পথ নয়”, “লি শুয়াং-শুয়াং-এর জীবনী”, ওয়াং ওয়েনশি’র “নতুন সাথী”, ওয়াং ইউয়ানচিয়ান-এর “পার্টি সভ্যপদের চাঁদা”, “সাতটি দেশলাই কাঠি”, রু চিচ্যুয়ান-এর “গাদা লিলি”, লিউ চেন-এর “দীর্ঘ প্রবাহিত স্রোত” ইত্যাদি রচনা বাস্তব জীবন থেকে উপজীব্য নিয়ে এক সজীব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে আর সৃষ্টি করেছে কয়েকটি নতুন চরিত্র। তা ছাড়া এই নবীন লেখক-লেখিকারা যে পরিপক্বতা লাভ করার দিকে এগিয়ে চলেছেন তারও আভাস আমরা তাঁদের এই সব রচনায় পাই। কাও ইং-এর “তাচি আর তার বাবা” নামক কাহিনীতে আমরা একদিকে য়ি জাতিসত্তার লোকেদের ক্রীতদাস সমাজব্যবস্থাধীন রক্ত ও অশ্রুঝরা দিনগুলির কথা জানতে পারি, আরেকদিকে দেখি হানজাতির প্রতি য়ি জাতির অতীতের সন্দেহ ও বিদ্বেষভাব অবসান করে দুই জাতির মধ্যে ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের একনিষ্ঠ প্রয়াস। মুক্তির পূর্বেই যে সব লেখক “ইয়ানআন সাহিত্য আলোচনার” পরপরই সাহিত্যসৃষ্টিতে ব্রতী হয়েছিলেন তাঁরাও নতুন পরিস্থিতির পটভূমিতে গল্প লিখতে শুরু করেন। চাও শুলি-এর “পোড় খাইয়ে নাও”, “নগ্ন হাত”, চৌ লিপো-এর “বিয়েবাড়ি”, “গম মাড়ানোর চত্বরে”, শা তিং-এর “অতিক্রম”, “রাতের বেলায় বৈঠক”, লুও পিনচি-এর “বাবা ও মেয়ে”, আই উ’র “বুনো ষাঁড়ের গাঁ”, লিউ শুতে’র “বুড়ো ষাঁড়ের শক্তি” আর মা ফং-এর “আমার প্রথম উপরওয়ালা” ও সি রোং-এর “লাই পিসি” ইত্যাদি কাহিনীগুলিতে নতুন জীবনের এক সজীব চিত্র ফুটে উঠেছে।
সমাজে চলাফেরা করা মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে গল্প-উপন্যাস। এই সব লোক নিয়েই সাহিত্যিকেরা সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন চরিত্র। কিন্তু এই চরিত্রগুলি আদৌ তাঁদের মনগড়া বস্তু নয়। এই সব চরিত্রের দোষ-গুণ তুলে ধরে লেখকেরা তাঁদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা একদিকে যেমন নয়া সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণকারী সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি দেখিয়ে দিয়েছেন “নান সূর্য”-এর শি তোংকান, “যৌবনের গান”-এর ওয়াং সিয়াওইয়ান-এর মতো সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয় এমন অগ্রণী ব্যক্তি; এক সাধারণ পরিবারের সরল ও মমতাময়ী “লিলি”-এর পুত্রবধূর মতো চরিত্র, আর, “লাল ঝাণ্ডার গীত”-এর ইয়ান চিহো, “পথ খোলার ইতিহাস”-এর বুড়ো লিয়াং সান, “পাহাড়তলীর বিরাট পরিবর্তন”-এর সোং ইয়ৌখিং—সেই সব আগের কালের পুরুষেরা যারা এককালে ক্লেশকর জীবনযাপন করেছে আর হাজার হাজার বছর ধরে সনাতনী ধ্যান-ধারণায় আবদ্ধ ছিল তারা নতুন সমাজের যত্নে পশ্চাৎপদ চিন্তাধারা কাটিয়ে উঠে যুগোপযোগী এক নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে। লেখকদের বাস্তবসম্মত ও জীবন্ত রূপায়ণে এবং শিল্পরীতির প্রভাবে এই সব চরিত্র পাঠকদের মনে গভীর দাগ কাটে, আর তাঁরা বিষয়বস্তুর রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত হন না। নেতিবাচক চরিত্র রূপায়ণেও লেখকেরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। “লাল সূর্য”-এর চাং লিংফু, “যৌবনের গান”-এর ইয়ু ইয়োংজে, “লাল পর্বতচূড়ার”-এর স্যু ফংফেই, “তিন পরিবারের গলি” র ছেন ওয়েনসিয়োং, “শাংহাই-এর প্রভাত”-এর স্যু য়িতে ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে পাঠকেরা সমাজে বিদ্যমান কলঙ্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় লাভ করেন এবং তাদের মন ঘৃণায় ভরে ওঠে।
পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধ থেকে ষাটের দশকের শুরুর মধ্যে চীনের কথাসাহিত্যের অগ্রগতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মুক্ত হয়। কিন্তু ইতিহাসের অগ্রগতি তো আর সমান্তরাল রেখা অনুসরণ করে চলে না। নয়া চীনের প্রথম সতের বছরের সাহিত্যও বাধাহীনভাবে এগিয়ে যেতে পারে নি। ১৯৫৭ সালের পর থেকে সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে একটার পর একটা আলোড়ন এবং শিল্প ও সাহিত্যসৃষ্টিতে তাত্ত্বিক প্রশ্ন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সাহিত্যের স্বাভাবিক অগ্রগতির পথকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে।
১৯৫৬ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনের সমাজতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে “শত ফুল বিকশিত হোক, শত মতবাদ বিরাজ করুক” নীতির কথা ঘোষণা করলে বহু লেখক এতে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের বিভিন্ন দিক তাঁদের রচনার প্রতিফলিত করতে সচেষ্ট হলেন। তাই ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে রচিত গল্প-উপন্যাসে এক নতুন হাওয়া বইতে দেখা গেল। কয়েকজন লেখক জীবনের নানা দিক পর্যবেক্ষণ করে জীবনের নঞর্থক দিকটাও তুলে ধরলেন। এমন সব গল্প-উপন্যাসের মধ্যে উৎকৃষ্ট রচনাগুলি হলো ওয়াং মং-এর “সাংগঠনিক বিভাগের নতুন যুবকর্মী”, লি চুন-এর “ধূসর রঙের পাল তোলা নৌকা”, নান তিং-এর “সেক্সন অফিসার”, কেং লোংসিয়াং-এর “পার্টি সভ্যপদ লাভ”, কেং চিয়ান-এর “ধ্বজাধারী”। এই সব কাহিনীর যে বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই তা হলো, লেখকেরা সবাই বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্বগুলির পরিবর্তন তাঁদের তীক্ষ্ণ লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সাহসের সঙ্গে সমাজতন্ত্রবিরোধী আমলাতন্ত্রবাদ, সঙ্কীর্ণতাবাদ, আত্মমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আর সমাজের কিছু লোকের অসংবৃত্তি বা অপকর্মের ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলি তাঁদের রচনায় ফুটিয়ে তুললেন। এরই সঙ্গে কিছু প্রেমিক-প্রেমিকার জীবন কাহিনীরও আবির্ভাব হয় যেমন তং ইয়ৌমেই-এর “খাড়া পাহাড়ের ওপর”, লু ওয়েনফু-এর “ছোট গলির গভীরে”, জোং ফু-এর “লাল ডাল” ইত্যাদি। এই সব কাহিনীতে প্রেমীযুগলের ভাব-প্রবণতা, তাদের অন্তরের কথা, অনুরাগ, মান-অভিমান ইত্যাদি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে এবং রসের সঞ্চার করেছে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু বহুমুখী করার প্রয়াসে এবং বাস্তব সমাজের বিভিন্ন দিক প্রতিফলনে এই সব রচনা যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ধরনের রচনা প্রকাশের অনতিকাল পরই এগুলো আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হয়ে উঠল ও তাদের অকালমৃত্যু ঘটল। আর ওয়াং মং, লু ওয়েনফু এবং বহু লেখকের লেখনী স্তব্ধ হলো।
১৯৫৮ সালের “বিরাট উল্লম্ফন” আর সাম্যবাদ এসে গেছে এই ধারণার বশবর্তী হলে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রও সীমিত হয়ে পড়ল। আবার আবির্ভাব হলো সাহিত্যের ক্ষেত্রে “নিষিদ্ধ এলাকা”।
১৯৬১-১৯৬৩ সালের মধ্যে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন নীতি অনুসৃত হবার ফলে এবং সাহিত্যসৃষ্টির পথ আরো উন্মুক্ত করার জন্যে গল্প-উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে আবার নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো। বিষয়বস্তুতেও রকমারিতার আবির্ভাব হলো, বিশেষ করে কিছু ঐতিহাসিক গল্প ও উপন্যাসের আবির্ভাব খুবই লক্ষণীয়। কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশী দিন টিকল না। “মধ্যপন্থী চরিত্র” সৃষ্টির নামে এবং “বাস্তবতাকে আরও গভীরে নিয়ে যাবার” নীতিতে কিছু কিছু গল্প ও উপন্যাস এবং ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত নাটক তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হলো। তাতে গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু আবার সীমিত হয়ে পড়ল, জীবন বর্ণনায় গভীরতার অভাব, চরিত্রসৃষ্টিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাব অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন লোকেদের চরিত্র নয়, একমাত্র বীর-ব্যক্তিদেরই তুলে ধরার প্রতিই ইচ্ছাকৃতভাবে জোর দেবার প্রচেষ্টা। লেখকদের বিভিন্ন শিল্পরীতির প্রতি স্বাভাবিক প্রবণতা “অপ্রলেতারীয় মনোবৃত্তি” বলে সমালোচিত হতে লাগল। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬-এর মধ্যে গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেল। তবু এই সময়পর্বের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো হাও রান-এর “উজ্জ্বল আকাশ” আর ছেন তংখো-এর “ঝড়বিদ্যুৎ” এই দুখানি উপন্যাসে গ্রামে শ্রেণীসংগ্রাম ও দুই লাইনের মধ্যে সংঘাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। এই সময়পর্বে সৈনিকদের জীবন নিয়ে রচিত দুটি সেরা গল্প হলো লিন ইয়ু-এর “পঞ্চাশটি প্রতিবন্ধক” আর রেন উপিন-এর “প্রতিকূল হাওয়ার বিরুদ্ধে নৌচালক”।
মুক্তির প্রথম সতের বছরে গল্প ও উপন্যাস সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। শিল্প ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সত্ত্বেও গল্প ও উপন্যাস সৃষ্টিতে সাহিত্যিকেরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ও শিক্ষা লাভ করেন তাও কোনো অংশে কম নয়।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তৎকালীন দেশরক্ষা মন্ত্রী লিন পিয়াও-এর পৃষ্ঠপোষকতায় চেয়ারম্যান মাও জেতুং-এর পত্নী চিয়াং ছিং, যিনি এর কিছুদিন আগে থেকেই চীনের রাজনীতি ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, শাংহাই শহরে চীনের মুক্তিফৌজের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। এই আলোচনা সভার যে কার্যবিবরণ তাঁরা প্রস্তুত করেন। তাতে বিগত সতের বছরের শিল্প ও সাহিত্যকে “পার্টি বিরোধী, সমাজতন্ত্রবিরোধী এবং মাওজেতুংচিন্তাধারার পরিপন্থী” বলে আখ্যা দেয়া হয়। অচিরেই শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টিতে মাও জেতুং নির্দেশিত পথ প্রত্যাখ্যান করা হলো, সাহিত্য উদ্যানের শত ফুল পদদলিত হলো আর বহু গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার হলেন ‘সংগ্রামের’ লক্ষ্যস্থল। চিয়াং ছিং আর তার গোষ্ঠী শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টিতে একটি ছক বেঁধে দিল। এই ছক-মাফিক গল্প, উপন্যাস বা নাটক না লেখা হলে লেখকের ভাগ্যে জুটতো মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন, কারাবাস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যু। আধুনিক চীনা সাহিত্যের সুসাহিত্যিক লাও শ এবং চাও শুলি’র অকাল মৃত্যু ঘটে এভাবেই। এক অস্বাভাবিক এবং অস্বস্তিকর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে শিল্প ও সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশে ও অগ্রগতিতে যে বাধা ঘটবে তা না বললেও চলে। তবে সাহিত্যসৃষ্টিতে এই পর্যায় যে একেবারে শূন্য ছিল সে-কথা বলা যায় না। যাঁরা ছকবাঁধা রচনায় ব্রতী হলেন তাঁরা শুধু রাজনৈতিক শ্লোগান আওড়ালেন আর ফুটিয়ে তুললেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে উদ্যোগী এক স্বার্থপর গোষ্ঠীর বিকৃত রাজনৈতিক মতবাদ। তাঁদের রচনায় সাহিত্যমূল্য বিশেষ নেই, বাস্তব সমাজের দ্বন্দ্বগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করার চেষ্টাই বেশী ব্যক্তি-পূজাই যেন সাহিত্যসৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য।
এই পর্বের প্রথম দিককার একটি উপন্যাস হলো “হোংনান-এ যুদ্ধের ইতিহাস”। এই উপন্যাসের পটভূমি পঞ্চাশের দশকে কৃষি সমবায় আন্দোলনে উদ্ভূত দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম হলেও বাস্তব অবস্থা ও জীবনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এর ভাষাও ধর্মোপদেশের মতো শোনায়। লিন পিয়াও-চিয়াং ছিং গোষ্ঠীর মতবাদ এতে ব্যক্ত হয়।
তাই এই উপন্যাসটিকে “আদর্শ” বা নমুনা রূপে গ্রহণ করা হয়। নান শাও-এর “নিউ থিয়ানইয়াং” ১৯৫৭ সালে ছাওশান অঞ্চলে স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নিউ থিয়ানইয়াং নামে পরিচিত এক জলাজমিতে বাঁধ দিয়ে তাকে চাষের উপযোগী করবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কিন্তু ১৯৬২ সালে মুক্তিফৌজ এই কাজটি হাতে নিলেই জনগণের আশা পূরণ হয়। এই হলো এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মুক্তিফৌজকে প্রাধান্য দেয়ার প্রচেষ্টায় স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এবং সেনাবাহিনী ও পার্টিকে পরস্পরবিরোধী শক্তিরূপে দেখানো হয়, আর তাতে “পার্টি বন্দুককে নিয়ন্ত্রণ করার” এই মার্কসীয় নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে “বন্দুক পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করবে” এই ভ্রান্ত নীতির গুণগান করা হয়। এই ধরনের অন্যান্য কয়েকটি উপন্যাস হলো হু ইনছিয়াং-এর “পূর্বাহ্ণ”, নু ছ্যুন-এর “আমাদের এই বংশধর”, আর শাংহাই জাহাজনির্মাণ কোম্পানীর শিল্প ও সাহিত্যসৃষ্টি গ্রুপ লিখিত “সমুদ্রে রাস্তা নির্মাণ”। মোটামুটি একই রাজনীতিক লাইন ফুটিয়ে তুললেও সাহিত্য গুণের দৃষ্টিতে যে দুটি উপন্যাস নয়া চীনের সাহিত্য ইতিহাসে উল্লেখ করার মতো যোগ্যতা রাখে তা হলো ছেন রোং-এর “দশ হাজার বছর সবুজ” আর হাও রান-এর “সোনালী পথ”।
এই পর্বে ছোটগল্পের অধিকাংশই নেতাদের প্রবচনের নামান্তর। তবে এই মতান্ধতা কাটিয়ে অপেক্ষাকৃত বাস্তবধর্মী এবং শিল্পরীতির প্রতি যথার্থ মর্যাদা দিয়ে চিয়াং জিলোং লিখেছেন “বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যুরোর ডিরেক্টরের জীবনের একটি দিন”, সুন চিয়ানচোং লিখেছেন “পাহাড়ী ঈগল ডানা মেলেছে”, হৌ চিয়ানপিং লিখেছেন “পথচিহ্ন”, চাং তংখুই লিখেছেন “শব্দবাহী তীর” ইত্যাদি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, চেয়ারম্যান মাও জেতুং-কে হত্যা করে রাষ্ট্র পরিচালনার একচ্ছত্র অধিকার লাভ করার চক্রান্ত ব্যর্থ হলে লিন পিয়াও স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। অতঃপর চীনের রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র চিয়াং ছিং এবং তার অনুগামীদের করায়ত্ত হয়। এর পাঁচ বছরের মধ্যেই চিয়াং ছিং চক্রের পতন হয়। আর চীনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সূচিত হয় এক নতুন যুগ। নয়া চীনের নয়া সাহিত্যের বিকাশের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে তারপর থেকে।
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, “গণ সাহিত্য” মাসিক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী পেইচিংস্থ চীনা সাহিত্যিকদের এক আলোচনা সভা আহ্বান করেন। এই সভায় সাহিত্যিকেরা কি করে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৯৭৮ সালের মে মাসে অখিল চীন শিল্পী ও সাহিত্যিক পরিষদের তৃতীয় বর্ধিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে চীনের প্রাদেশিক শিল্পী ও সাহিত্যিক সমিতি ও তার অধীনস্থ শাখাগুলোকে সক্রিয় করে তুলবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সালেরই দ্বিতীয়ার্ধে অনুশীলনই যে সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার একমাত্র মাপকাঠি তা অনুধাবন করবার জন্য দেশব্যাপী আলোচনা শুরু হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন চীনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পার্টির ঐতিহ্য ও ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার সংকল্প গ্রহণ করে। এর পর যে সব সাহিত্যিক ১৯৫৭ সালের “দক্ষিণপন্থী বিরোধী” আন্দোলনের শিকার হয়েছিলেন এবং লেখক জীবন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তাঁদের এবং “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় অনুরূপ দশায় পড়েছিলেন তাঁদেরও পুনর্বাসিত করা হয়। সাহিত্য সেবায় আবার ব্রতী হওয়ার সুযোগ পেয়ে এঁরা আবার লেখনী তুলে নিলেন। এরপর থেকে কিছু নতুন লেখকেরও আবির্ভাব হতে থাকে। হয়ত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বিগত এক যুগের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেই কথাই গল্প-উপন্যাসে ধরে রাখবার জন্যই এমন কতকগুলো ছোট গল্প ও উপন্যাসের আবির্ভাব হয় যাতে প্রকাশ পায় “ঘায়ের দাগ”। তাই সত্তরের দশকের শেষের দিককার সাহিত্যকে অনেকে “ঘায়ের দাগ” সাহিত্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। ক্রমশঃ সমাজে বিদ্যমান অন্যায়গুলো, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মানবাধিকার, প্রেম ইত্যাদি যে সব বিষয় এযাবৎ সাহিত্যক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ছিল তা আবার গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে ঠাঁই পেতে থাকে।
১৯৭৬ সালেই লেখক মু কুওচেং “আমাদের বাবুর্চি” নামে একটি গল্পে বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং দেশের অর্থনৈতিক গঠনকাজে আত্মনিয়োগকারী একজন বৈজ্ঞানিক “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় যে দুর্দশার মধ্যে পড়েছিলেন। সেই কথাই বর্ণনা করেছেন। এক পারিবারিক জীবনকে কেন্দ্র করে এবং ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত এই গল্পটি ভাষা ও শিল্পরীতির দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত। ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত চিয়াং জিলোং-এর “বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যুরোর ডিরেক্টরের জীবনের একটি দিন” কারখানার শ্রমিক ও কর্মীদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করলেও তৎকালীন নেতারা এর তীব্র সমালোচনা করেন। ফলে, চিয়াংকে সাহিত্য সেবা থেকে বিরত হতে হয়। অবস্থার পরিবর্তন হলে তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে আবার লিখতে শুরু করেন, এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই “রক্তক্ষয়ী হৃদয়”, “ম্যানেজার ছিয়াও-এর পদ গ্রহণ” ও “শেষ বছর” নামে তিনটি গল্প লিখে ফেলেন। “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় ‘রাজনীতিকে’ প্রাধান্য দিয়ে কারিগরী বিদ্যা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রকে হেয় করাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে অরাজকতা ও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সেই বাস্তব চিত্রই তিনি ফুটিয়ে তুললেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে।
“সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” যুগে নেতাদের হুকুমই ছিল আইন। সমাজে আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত কর্মীরা হয়ে পড়লেন আজ্ঞার দাস। যাঁরা নিজেদের বিবেক অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করতেন তাঁদের ভাগ্যে জুটত অশেষ দুর্দশা। এমনই এক দুর্ভাগা পুলিশ-কর্মীকে কিভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে ফেলা হয় সেই কথাই বর্ণিত হয়েছে লেখক ওয়াং ইয়ানফিং-এর “পবিত্র ব্রত” নামে গল্পে।
প্রসিদ্ধ লেখক লিউ সিনউ-এর “ক্লাস টীচার” গল্পটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠক মহলে এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। একজন শিক্ষকের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মাধ্যমে “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” জনজীবনে ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে দুর্দশা ডেকে এনেছিল এবং সমাজে এক বিষময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তার এক বাস্তবভিত্তিক চিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
উ ছিয়াং-এর “আত্মার সংগ্রাম” এবং ওয়াং মং-এর “অমূল্য” নামে গল্প দুটিতে “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় কয়েকজন সত্যাশ্রয়ীর মনের গভীরে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং নিরুপায় হয়ে তাঁরা যে অন্তরের জ্বালা অন্তরেই জমা রাখতেন সেই কথা ব্যক্ত হয়েছে।
আশির দশক থেকে আবির্ভাব হতে থাকে জীবনের নানা দিক এবং মানুষের অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে লিখিত বহু গল্প ও উপন্যাস। নতুন কৃষি নীতির জন্য ১৯৭৯ সাল থেকে গ্রামীণ চীনে যে পরিবর্তন আসতে থাকে সেই চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন কু হুয়া এবং অন্যান্য কয়েকজন লেখক। “তিক্ত বসন্ত-এক ট্রাক চালকের কাহিনী” গল্পে প্রবীণ লেখক চাং সিয়ানলিয়াং চীনের সুদূর পশ্চিমাঞ্চলে এক ট্রাক চালকের জীবনী বর্ণনা করেছেন। ১৯৮০ সালে মহিলা লেখিকা শেন রোং-এর “মধ্যবয়স এলে” গল্পটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং তা খুব বিতর্কেরও সৃষ্টি করে। এই গল্পে লেখিকা মূলতঃ মধ্যবয়সী বুদ্ধিজীবীদের সমস্যা প্রতিফলিত করেছেন। লেখিকা চাং চিয়ে-এর “বনের সঙ্গীত” নামক গল্পে মধ্যবয়সী আমলাসুলভ কর্মীদের বাস্তব অবস্থার প্রতি পরাখ হবার কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তাঁর “ভালবাসা ভুলবার নয়” কাহিনীটি নিছক প্রেমকাহিনী নয়, এটি শিক্ষামূলকও বটে। এক বেকার মেয়ের জীবনকে কেন্দ্র করে গল্প লিখেছেন তং কেং। যুগের পরিবর্তন এলেও অনেকে যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারলেন না, এমনই এক জেদী আর গোঁড়া চরিত্র উপস্থাপিত করেছেন নবীন লেখক লি হাং ইয়ু তাঁর “শেষ আঁকশি” গল্পে। “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় নির্যাতিত ও নির্বাসিত লেখক লু ওয়েনফু-এর “সীমানার পাঁচিল” একটি ব্যঙ্গ রচনা।
মোট কথা, লেখকেরা এখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওজেতুংচিন্তাধারার প্রতি নিষ্ঠা রেখে সাহিত্য সেবায় ব্রতী হয়েছেন। অবশ্য এঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারেন। তার জন্য তাঁরা সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠলেও তাঁদের রচনা সাহিত্য সমালোচনার স্বাভাবিক মাপকাঠিতেই বিচার্য হবে। তাই বলে তাঁদের হাত থেকে লেখনী ছিনিয়ে নেয়া হবে না। আজকের দিনের সাহিত্যিকেরা এই নিশ্চয়তা পেয়েছেন বলেই নয়া চীনের নয়া সাহিত্যের উদ্যানে বর্তমানে নানা প্রকার ফুল বিকশিত হতে শুরু করেছে।
সেন নালান
১৯১৯ সালের ‘৪ঠা মে আন্দোলন’ আধুনিক চীনা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব এনেছিল তা ছিল নয়া গণতন্ত্র পর্যায়ের বিপ্লবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তখনকার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনোভাব। আর বহু লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজতন্ত্রের চিন্তাও প্রকাশ পায়। বিপ্লবে সাফল্য অর্জন করে ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনের সর্বহারাশ্রেণী প্রতিষ্ঠিত করল নিজেদের রাষ্ট্র। নির্যাতিত নিষ্পেষিত জনগণ হলো রাষ্ট্রের মালিক। রাষ্ট্রের চরিত্র গেল পাল্টে। সেই সঙ্গে চীনা সমাজেও এল আমূল পরিবর্তন। হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা সামন্ততন্ত্রের জঞ্জাল পুড়িয়ে ফেলে শুরু হলো নতুন সমাজ গঠনের মহান ব্রত, আর সেই সমাজের নায়ক হলো একদা অনাহারী, অর্ধভুক্ত জমিহারা, হালছাড়া কোটি কোটি কৃষক ও শোষিত শ্রমিক। তাই, স্বাভাবিকভাবে এরাই হলো নয়া সাহিত্যের মুখ্য নায়ক। আগেকার সাহিত্যে শুধু সমাজের “সাহেব-বিবিদের” বিলাসপূর্ণ জীবন প্রতিফলনের স্থলে “গোলামদের” আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা প্রতিফলিত হতে থাকল। সমাজতন্ত্রের পর্যায় পেরিয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য সমাজব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসতে থাকে তাতে সাহিত্যও চরিত্র ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক হয়ে ওঠে যার প্রাণ হলো সাম্যবাদ চিন্তাধারা।
১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে, চীনের শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় স্থির হয় যে, নয়া চীনের সকল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকাজের প্রথম লক্ষ্য হবে শ্রমিক কৃষক সৈনিকদের সেবা করার যে প্রস্তাব মাও জেতুং সাত বছর আগে ইয়ানআনে দিয়েছিলেন। শিল্প-সাহিত্য যে রাজনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক ব্রতেরও সেবা করবে সে-কথাও মাও জেতুং তখন বলেন। কিন্তু পরে এই নীতি বাস্তব প্রয়োগের সময় অনেক শিল্পী ও সাহিত্যিক তথাকথিত রাজনীতি ও সমাজতন্ত্রের সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন।
১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে বলা হয় যে, ব্যাপক ও জ্বালামুখী শ্রেণীসংগ্রাম মূলতঃ শেষ হয়েছে এবং আগামী দিনের মুখ্য দায়িত্ব হবে সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ সাধন। শ্রেণী-সম্পর্ক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং নতুন দায়িত্ব পালনের তাগিদে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সেবা করার পরিধি, লক্ষ্যবস্তু আর বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন এল।
১৯৬২ সালের ২৩ মে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র “রেনমিন রিপাও”, “বৃহত্তর জনগণের সেবা করুন” শীর্ষক এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত করে। এতে বলা হয় যে, শিল্প ও সাহিত্য চীনের সব জাতিসত্তার শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য মেহনতী জনগণ, সব গণতান্ত্রিক পার্টি ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবিশেষ, স্বদেশভক্ত জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী, দেশহিতব্রতী প্রবাসী চীনা ও সকল স্বদেশভক্ত ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এবং শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক প্রাধান্য ব্যাপক জনগণের সেবা করবে ও তাদেরই হিতকার্যে নিয়োজিত থাকবে। এতে আরো বলা হয় যে, শিল্প ও সাহিত্য শ্রমিকশ্রেণীর প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যতদূর সম্ভব সমাজের ব্যাপক স্তরের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, আর সকলকার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য সারা দেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই নীতি এবং ইতোপূর্বে মাও জেতুং উত্থাপিত “শত ফুল বিকশিত হোক ও শত মতবাদ বিরাজ করুক” চীনের তৎকালীন সমাজ-অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও নয়া চীনের সাহিত্য উদ্যানে শত ফুলের সমারোহ অচিরেই অন্তর্হিত হলো। ১৯৬৬ সাল থেকে “সংশোধনবাদী সাহিত্য’র বিরোধিতার নামে সাহিত্যের মানদণ্ড হিসেবে রাজনীতিই হলো মুখ্য আর মাও জেতুং উত্থাপিত অন্যান্য মানদণ্ড হলো পরিত্যক্ত। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম ও “বামঝোঁকের” ফলে উদ্ভূত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলল দীর্ঘ দশ বছর।
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, শিল্প ও সাহিত্য জনগণ ও সমাজতন্ত্রের সেবা করবে। এই উপলব্ধি মাও জেতুং-এর শিল্প ও সাহিত্য চিন্তাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
নয়া চীনের সমাজতন্ত্র বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাহিত্যের বিশেষত্ব মনে রেখে আমরা তার নয়া সাহিত্যের অগ্রগতিকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।
এক, উদ্যোগপর্বের অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরকালীন নয়া সাহিত্যের জন্ম ও অগ্রগতির পর্যায়—১৯৪৯ থেকে ১৯৬৬। এই সময়পর্ব হলো পুরনো ধ্যান-ধারণা ও সামন্তবাদের অবশিষ্ট ও অবক্ষয়ী ভাবধারাকে বিদায় দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ও নতুন ভাবধারা কায়েম করার এবং সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের পর্ব। এই পর্বে চীনের জাতীয় অর্থনীতিকে দ্রুত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সুপরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক গঠনকাজ চালানো হয়, দেশের বেশির ভাগ এলাকায় উৎপাদন-উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটিয়ে নয়া গণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হয়। তাই, এই পর্বে সৃষ্ট সাহিত্যে আমরা দেখতে পাই বিপ্লবী সংগ্রামের চিত্র, সমাজতান্ত্রিক মনোভাব এবং সাম্যবাদ চিন্তাধারায় স্নাত নতুন মানুষ, নতুন ঘটনা এবং শ্রেণীসংগ্রামের এক জাজ্বল্য চিত্র।
দুই, ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ পর্যায়ের সাহিত্য—১৯৬৬-১৯৭৬। এই সময়পর্বে চীনের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে তুলকালামের সৃষ্টি হয় তার মূলে ছিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব। এ-সম্পর্কে বলা হয়েছে: “ইতিহাস স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভ্রান্ত অনুধাবনের বশবর্তী অবস্থায় একজন নেতা কর্তৃক সূচিত এবং প্রতিবিপ্লবী চক্র কর্তৃক আত্মস্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহৃত ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ অভ্যন্তরীণ গোলযোগে পর্যবসিত হয়েছিল এবং পার্টি, রাষ্ট্র ও সমগ্র জনগণের জন্য এনেছিল মহাবিপর্যয়।” (দ্রষ্টব্য : চীনের দলিল: চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর পার্টির ইতিহাসের কতকগুলো প্রশ্ন সম্পর্কে প্রস্তাব (১৯৪৯-১৯৮১), বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পেইচিং, ১৯৮১, পৃ: 88)।
এই সময়পর্বে চীনের অর্থনৈতিক গঠনকাজে যেমন ছিল ব্যর্থতার দিক তেমনি ছিল এক বিরাট সাফল্যের দিক। সাহিত্য ক্ষেত্রেও অনুরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব দেখা যায়। শিল্প ও সাহিত্যের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য আট-দফা নীতি গৃহীত হলে অবস্থার কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবার আগেই শুরু হয় শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে “সংশোধনবাদ বিরোধী ও সংশোধনবাদ প্রতিরোধ” সংগ্রাম। শুরু হলো কয়েকখানি উপন্যাস, নাটক, পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাহিত্যিক মহলে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত সমালোচনা ও বিষোদ্গার। সাধারণ এবং স্বাভাবিক সমালোচনার গণ্ডী ছাড়িয়ে তাঁদের প্রতি আক্রমণ শ্রেণী-সংগ্রামের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যেমন ১৯৫৯ সালে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সুসাহিত্যিক উহান রচিত “হাইরুই-এর পদচ্যুতি” নামক নাটকটি ১৯৬৫ সালে তীব্র সমালোচনার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং তাতেই সূচিত হয় ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’।
তিন, ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবোত্তর’ পর্যায়—১৯৭৭ সাল থেকে শুরু। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লিন পিয়াও চীনের রাজনীতি এবং পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকাংশ ক্ষমতা চিয়াং ছিং, ওয়াং হোংওয়েন, চাং ছুনছিয়াও এবং ইয়াও ওয়েনইউয়ান-এর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা জনগণের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও জেতুং-এর তিরোধান হয়। বৃহত্তর জনগণের সমর্থন না থাকায় চিয়াং ছিং চক্রের পতন ঘটে অক্টোবর মাসে। এই পতনের পর থেকে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে এক নতুন যুগ।
আগেই বলা হয়েছে, নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর চীনা সমাজে যে যুগসৃষ্টিকারী পরিবর্তন আসতে থাকে তা সাহিত্যিকদের জন্য উন্মুক্ত করে এক সীমাহীন দিগন্ত। নতুন নতুন চরিত্র, নতুন নতুন ঘটনা সাহিত্যিকদের সামনে হাজির করে অফুরন্ত উপাদান। তাই, নয়া চীনের প্রথম তিরিশ বছরের গল্প-উপন্যাস বাস্তব জীবনের ব্যাপকতা ও গভীরতা প্রতিফলনে এবং রচনার গুণগত ও সংখ্যাগত দিক থেকে ১৯১৯-এর ৪ঠা মে আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৯-এর মুক্তি পর্যন্ত তিরিশ বছরের সাহিত্যকে ছাড়িয়ে যায়, এবং বিরাট অগ্রগতি লাভ করে। মুক্তির প্রথম সতের বছরের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজ-জীবনের পরিবর্তনের সাথে সাথে এবং সাহিত্য বিকাশের নিজস্ব নিয়মেই প্রতিটি পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য সাহিত্যেও পরিস্ফুট হয়েছে। দেশের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আবর্তন-বিবর্তন অগ্রগতির ছবি গল্পকারেরা তাঁদের গল্পে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন।
১৯৫০-এর পরবর্তী দু-তিন বছর গল্পে, নভেলা ও উপন্যাসে চীনের মুক্তি সংগ্রাম এবং জাপ-প্রতিরোধ যুদ্ধই প্রতিফলিত হয়েছে বেশী। লিউ পাইইয়ু হলেন একজন সার্থক লেখক যিনি নয়া চীন প্রতিষ্ঠার শুরুতেই চীনের ইতিহাসের এই অধ্যায়টি সাহিত্যের রূপের মাধ্যমে অক্ষয় করে রেখেছেন। তাঁর রচিত “অগ্নিশিখার সামনে” নামক কাহিনীতে হুপেই প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে একটি নদী পার হবার সময় মুক্তিফৌজের সৈনিকেরা যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন তা বর্ণিত হয়েছে। লেখক মা চিয়া’র “যে ফুল কখনো শুকাবে না” নামক কাহিনীতে এক বিপ্লবী সৈনিকের আত্মত্যাগের আদর্শ ও সংখ্যালঘু জাতির প্রতি কমিউনিস্ট পার্টির নীতি বন্দিত হয়েছে। খোং চ্যুয়ে এবং ইউয়ান চিং লিখিত “নতুন বীর ছেলে-মেয়েদের উপাখ্যান” নামক কাহিনীতে জাপ-প্রতিরোধ যুদ্ধে চীনের যুবক-যুবতীরা যে আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমিকের দৃষ্টান্ত স্থাপিত করেছিল সেই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ছেন তেংখে তাঁর “জীবন্ত মানুষের দেয়াল” নামক কাহিনীতে চীনের মুক্তি সংগ্রামের এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। একই বিষয়বস্তু নিয়ে “ব্রোঞ্জের দেয়াল” নামে একটি নভেলা লিখেছেন প্রসিদ্ধ লেখক লিউ ছিং।
নয়া চীন প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র কোরিয়া আমেরিকার আক্রমণের শিকার হলে এবং চীনের ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব বিপদের সম্মুখীন হলে চীন দেশের দিকে দিকে “আমেরিকার প্রতিরোধ করো, কোরিয়াকে সাহায্য করো” ধ্বনি সোচ্চার হয়ে ওঠে। তখন অগণিত চীনা যুবক-যুবতী এবং প্রবীণ বিপ্লবী ও যোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবকরূপে কোরিয়াবাসীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকে আত্মবিসর্জন দেন। তাঁদের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কাহিনী এবং প্রগাঢ় আন্তর্জাতিকতাবাদ চীনা সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে চির-অমর করে রেখেছেন। ইয়াং শুও’র “তিন হাজার লি বিস্তৃত নদী ও পাহাড়” এবং লু চুকুও-এর “শাংকানলিং পাহাড়ে” নামক কাহিনী দুটি পাঠকদের মনে গভীরভাবে সাড়া জাগায়। লু লিং-এর “জলাভূমিতে যুদ্ধাভিযান” কাহিনীটিতেও কোরিয়া রণক্ষেত্রে চীনা সংগ্রামীদের জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।
মুক্তির পরই গ্রামীণ চীনে সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করে সমাজবাদী সমাজ গঠনের আন্দোলন শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকে গ্রামীণ চীনের পটভূমিতে যে সব কাহিনী সৃষ্টি হয় তার মধ্যে বিখ্যাত হলো চাও শুলি’র “রেজিষ্ট্রেশন”, কু ইয়ু-এর “নতুন ঘটনা নতুন ব্যবস্থা”, মা ফং-এর “বিবাহ” ও “ধুনকল”, কাও সিয়াওসেং-এর “অঙ্গীকার” কাহিনীগুলোর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সব কাহিনীর অধিকাংশেই গ্রামের সামন্তবাদী সমাজের পারিবারিক ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিবাহ প্রথা ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
১৯৫৩ সালে চীন জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ সম্পন্ন করে সমাজ সংস্কার ও সমাজতন্ত্র গঠনের পর্যায়ে পা দিল। উৎপাদন সম্পর্কের বিরাট পরিবর্তন চীনের সমাজ-জীবনেও এনে দেয় আমূল পরিবর্তন। তাই এই সময়কার গল্প-উপন্যাসেও আমরা এক নতুন রূপ দেখতে পাই।
প্রথমতঃ, ভূমি সংস্কার এবং কৃষি সমবায় কৃষকদের জীবনে পরিবর্তন আনতে থাকে আর সেই সঙ্গে কিছু দ্বন্দ্বেরও আবির্ভাব হতে থাকে। এমন এক দ্বন্দ্বের ছবি তুলে ধরেছেন লি চুন তাঁর “ওই পথ নয়” গল্পে। চাও শুলি-ও তাঁর “সানলি ওয়ান” নামক কাহিনীতে কৃষি সমবায় বাস্তবায়িত করবার সময় চীনের গ্রামে যে জটিল সংগ্রাম চলে তা প্রতিফলিত করেছেন। এরূপ বিষয়বস্তু নিয়ে ঔ ইয়াংশান লিখেছেন “উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ”, ওয়াং সিচিয়ান লিখেছেন “বসন্ত আহ্বানের গান”, লিউ শুতে লিখেছেন “সেতু”। তখনকার গ্রামের জনজীবন নিয়ে খাং চুও লিখেছেন “বসন্তে রোপণ শরতের ফসল”, ছিন চাওইয়াং লিখেছেন “গ্রামের কথা”। নতুন জীবনের সাথে সাথে জনগণের চিন্তাজগতেও যে পরিবর্তন আসতে থাকে সে-ই কাহিনীই ফুটে উঠেছে তাঁদের এই দুটি গল্পে। লিউ শাওথাং-এর “নতুন ডাল সবুজ পাতা”, লুও পিনচি-এর “রাত্রে হলুদ মাটির ঢিবি পার”ও এই বিষয়বস্তু নিয়ে লিখিত হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ, বিপ্লবী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে রচিত কাহিনীরও আবির্ভাব হতে থাকে এই সময়ে। এই ধরনের গল্প-কাহিনীর মধ্যে চুন ছিং-এর “নদীর পাড়ে ঊষার উদয়” এবং ওয়াং ইউয়ানচিয়ান-এর “পার্টি সভ্যপদের চাঁদা” কে প্রতিনিধিত্বমূলক রচনা বলে গণ্য করা যেতে পারে। “নদীর পাড়ে ঊষার উদয়” গল্পের সিয়াও ছেন ও তার পরিবারের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের দৃশ্য এবং “পার্টি সভ্যপদের চাঁদা” গল্পের হুয়াং সিন-এর বিপ্লবের জন্য আত্মবিসর্জনের আদর্শ সবাইকে অনুপ্রাণিত করে ও পাঠকদের চিত্তে গভীর দাগ কাটে। মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিতে লিখিত দীর্ঘ উপন্যাসগুলোর মধ্যে আছে তু ফেংছেং রচিত “ইয়ানআনকে রক্ষা করো”, সুন লি রচিত “ঝড়ের বছরগুলি”, কাও ইয়ুলান রচিত “ছোট শহরের ইতিবৃত্ত”।
উপরোক্ত দুটি বৈশিষ্ট্য ছাড়া এই সময়কার সাহিত্যের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো যে, জীবনের নানা দিক গল্প-উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। ছাও মিং-এর “রেল ইঞ্জিন”, পাই লাং-এর “ভবিষ্যৎ সুখের জন্য”, চৌ লিপো’র “গলিত লৌহস্রোত”, লেই চিয়া-এর “ইয়ালু নদীর পাড়ে এলো বসন্ত” ইত্যাদি রচনায় লেখকেরা শ্রমিকদের জীবন বর্ণনায় তাদের শুধু কারখানা ও যন্ত্রপাতির মধ্যেই আবদ্ধ না রেখে তাদের ঘরোয়া জীবনকেও স্থান দিলেন। শ্রমিকদের জীবন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় বা ইতোপূর্বে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে সাহিত্যও খুব বেশী না থাকায় এই সব লেখক শ্রমিকদের জীবনের গভীরে যেতে পারেন নি। আর তাঁদের চরিত্রসৃষ্টিতেও বলিষ্ঠতার অভাব দেখা যায়। তবে, নয়া চীন প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরই উৎপাদন পুনরুদ্ধার আর বৃদ্ধির ফলে শ্রমিকদের একদা অশান্তির জীবনে যে পরিবর্তন আসতে থাকে তা যথাসম্ভব দ্রুত সাহিত্যে প্রতিফলনে এই সব লেখকের অবদান অনস্বীকার্য।
একই সময়ে, চীনের অন্যান্য জাতিসত্তার লোকেদের—যাদের এক সময় হেয় করা হতো—জীবন নিয়ে গল্প-উপন্যাস সৃষ্টি হতে থাকে; আর সবচেয়ে বড় কথা তাদেরই মধ্য থেকে আবির্ভাব হতে থাকে নতুন নতুন লেখকের। এই সব জাতির লেখকেরা নিজ নিজ জাতির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনযাত্রা, নতুন সমাজব্যবস্থায় তাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি আর তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে, বিশেষ করে সংখ্যাগুরু হান-জাতির সঙ্গে ঐক্য স্থাপনার প্রচেষ্টা ফুটিয়ে তুললেন তাঁদের রচনায়। মুক্তির অনতিকাল পরই প্রকাশিত মালছিন হু’র “খোরছিন তৃণভূমির মানুষ”, ফেং সিখো’র “সোনালী সিংলিং গিরিশিখর”, লি ছিয়াও-এর “উচ্ছলিত চিনশা নদী” এই বিষয়বস্তু নিয়ে সার্থক ও তাৎপর্যপূর্ণ রচনা।
এই সময়পর্বে নয়া চীনের কিশোর ও শিশু সাহিত্যও বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। নয়া সমাজের ছোটদের স্বদেশচেতনা ও বুদ্ধিবিকাশ এবং নিয়মানুবর্তিতা ও সমবয়সীদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার শিক্ষা দেয় এই সব গল্প। চাং থিয়ানয়ি তাঁর “লুও ওয়েনই-এর কাহিনী” চিন্তা এবং শিল্পরীতির দিক থেকে সাফল্য অর্জন করে এবং কিশোরদের মনে গভীর দাগ কাটে। ইয়ান ওয়েনচিং, ইউয়ান চিং, হু ছি, হো য়ি, চিন চিন ইত্যাদি লেখকদের রচনাও শিক্ষামূলক ও কিশোরদের মন কেড়ে নেয়।
সৈনিক জীবন নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টিও এই সময়পর্বে ব্যাপকতা লাভ করে। ইতোপূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের সংগ্রামী জীবনকেই কেন্দ্র করে রচিত হত নানা কাহিনী। এই পর্বে দেশ গড়া ও উৎপাদন কাজের সঙ্গেও তাদের একাত্ম হয়ে যাবার কাহিনীও সাহিত্যে প্রতিফলিত হতে থাকে। শি ইয়ের “থিয়ানশান পর্বতের ওপর উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ” এই বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত একটি সার্থক উপন্যাস।
চীনের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জীবন নিয়ে রচিত গল্প-উপন্যাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। হানজাতিভুক্ত লেখকেরা এবিষয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এই সব লেখকের অধিকাংশই সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাস করে এই জাতিসত্তাসমূহের জীবন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করে তবেই লিখতে পেরেছেন বাস্তবধর্মী বহু গল্প ও উপন্যাস। এতে চীনা সাহিত্যের একটি শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব হয়। আলোচ্যপর্বে, লু তি’র “মনোরম দক্ষিণ প্রান্ত”, লিন ইয়ু-এর “সীমান্তের আলোকসঙ্কেত” এবং কুও কুওফু’র “আমেং উপজাতিদের মধ্যে” কাহিনীগুলোতে যথাক্রমে থুং জাতিসত্তার এবং কাওয়া জাতিসত্তার সামন্ততান্ত্রিক অবশিষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্যু হুয়াইচোং-এর “আমরা রোপণ করি প্রেমের বীজ” কাহিনীটিতে তিব্বতি জাতিসত্তার লোকেদের নতুন জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।
এই সময়পর্বে বুদ্ধিজীবীদের জীবন নিয়ে যে উপন্যাসটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে তা হলো হান শুই-এর “বীরের মতো এগিয়ে যাও”। এই উপন্যাসটি চিন্তা ও শিল্পরীতিতে খুব উন্নত না হলেও লেখক এতে এক নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছেন।
এই সময়পর্বে ছোটগল্পেরও আবির্ভাব হয় বেশী। নব উদিত লেখকদের মধ্যে অনেকেই দু’একটি গল্প লিখেই সাহিত্যিকদের মধ্যে স্থান করে নেন। শুধু বিষয়বস্তু চয়নে নয় ভাষা ও শিল্পরীতির দিক থেকেও তাঁরা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেন। লি চুন-এর “ওই পথ নয়”, “লি শুয়াং-শুয়াং-এর জীবনী”, ওয়াং ওয়েনশি’র “নতুন সাথী”, ওয়াং ইউয়ানচিয়ান-এর “পার্টি সভ্যপদের চাঁদা”, “সাতটি দেশলাই কাঠি”, রু চিচ্যুয়ান-এর “গাদা লিলি”, লিউ চেন-এর “দীর্ঘ প্রবাহিত স্রোত” ইত্যাদি রচনা বাস্তব জীবন থেকে উপজীব্য নিয়ে এক সজীব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে আর সৃষ্টি করেছে কয়েকটি নতুন চরিত্র। তা ছাড়া এই নবীন লেখক-লেখিকারা যে পরিপক্বতা লাভ করার দিকে এগিয়ে চলেছেন তারও আভাস আমরা তাঁদের এই সব রচনায় পাই। কাও ইং-এর “তাচি আর তার বাবা” নামক কাহিনীতে আমরা একদিকে য়ি জাতিসত্তার লোকেদের ক্রীতদাস সমাজব্যবস্থাধীন রক্ত ও অশ্রুঝরা দিনগুলির কথা জানতে পারি, আরেকদিকে দেখি হানজাতির প্রতি য়ি জাতির অতীতের সন্দেহ ও বিদ্বেষভাব অবসান করে দুই জাতির মধ্যে ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের একনিষ্ঠ প্রয়াস। মুক্তির পূর্বেই যে সব লেখক “ইয়ানআন সাহিত্য আলোচনার” পরপরই সাহিত্যসৃষ্টিতে ব্রতী হয়েছিলেন তাঁরাও নতুন পরিস্থিতির পটভূমিতে গল্প লিখতে শুরু করেন। চাও শুলি-এর “পোড় খাইয়ে নাও”, “নগ্ন হাত”, চৌ লিপো-এর “বিয়েবাড়ি”, “গম মাড়ানোর চত্বরে”, শা তিং-এর “অতিক্রম”, “রাতের বেলায় বৈঠক”, লুও পিনচি-এর “বাবা ও মেয়ে”, আই উ’র “বুনো ষাঁড়ের গাঁ”, লিউ শুতে’র “বুড়ো ষাঁড়ের শক্তি” আর মা ফং-এর “আমার প্রথম উপরওয়ালা” ও সি রোং-এর “লাই পিসি” ইত্যাদি কাহিনীগুলিতে নতুন জীবনের এক সজীব চিত্র ফুটে উঠেছে।
সমাজে চলাফেরা করা মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে গল্প-উপন্যাস। এই সব লোক নিয়েই সাহিত্যিকেরা সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন চরিত্র। কিন্তু এই চরিত্রগুলি আদৌ তাঁদের মনগড়া বস্তু নয়। এই সব চরিত্রের দোষ-গুণ তুলে ধরে লেখকেরা তাঁদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা একদিকে যেমন নয়া সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণকারী সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি দেখিয়ে দিয়েছেন “নান সূর্য”-এর শি তোংকান, “যৌবনের গান”-এর ওয়াং সিয়াওইয়ান-এর মতো সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয় এমন অগ্রণী ব্যক্তি; এক সাধারণ পরিবারের সরল ও মমতাময়ী “লিলি”-এর পুত্রবধূর মতো চরিত্র, আর, “লাল ঝাণ্ডার গীত”-এর ইয়ান চিহো, “পথ খোলার ইতিহাস”-এর বুড়ো লিয়াং সান, “পাহাড়তলীর বিরাট পরিবর্তন”-এর সোং ইয়ৌখিং—সেই সব আগের কালের পুরুষেরা যারা এককালে ক্লেশকর জীবনযাপন করেছে আর হাজার হাজার বছর ধরে সনাতনী ধ্যান-ধারণায় আবদ্ধ ছিল তারা নতুন সমাজের যত্নে পশ্চাৎপদ চিন্তাধারা কাটিয়ে উঠে যুগোপযোগী এক নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে। লেখকদের বাস্তবসম্মত ও জীবন্ত রূপায়ণে এবং শিল্পরীতির প্রভাবে এই সব চরিত্র পাঠকদের মনে গভীর দাগ কাটে, আর তাঁরা বিষয়বস্তুর রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত হন না। নেতিবাচক চরিত্র রূপায়ণেও লেখকেরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। “লাল সূর্য”-এর চাং লিংফু, “যৌবনের গান”-এর ইয়ু ইয়োংজে, “লাল পর্বতচূড়ার”-এর স্যু ফংফেই, “তিন পরিবারের গলি” র ছেন ওয়েনসিয়োং, “শাংহাই-এর প্রভাত”-এর স্যু য়িতে ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে পাঠকেরা সমাজে বিদ্যমান কলঙ্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় লাভ করেন এবং তাদের মন ঘৃণায় ভরে ওঠে।
পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধ থেকে ষাটের দশকের শুরুর মধ্যে চীনের কথাসাহিত্যের অগ্রগতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মুক্ত হয়। কিন্তু ইতিহাসের অগ্রগতি তো আর সমান্তরাল রেখা অনুসরণ করে চলে না। নয়া চীনের প্রথম সতের বছরের সাহিত্যও বাধাহীনভাবে এগিয়ে যেতে পারে নি। ১৯৫৭ সালের পর থেকে সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে একটার পর একটা আলোড়ন এবং শিল্প ও সাহিত্যসৃষ্টিতে তাত্ত্বিক প্রশ্ন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সাহিত্যের স্বাভাবিক অগ্রগতির পথকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে।
১৯৫৬ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনের সমাজতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে “শত ফুল বিকশিত হোক, শত মতবাদ বিরাজ করুক” নীতির কথা ঘোষণা করলে বহু লেখক এতে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের বিভিন্ন দিক তাঁদের রচনার প্রতিফলিত করতে সচেষ্ট হলেন। তাই ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে রচিত গল্প-উপন্যাসে এক নতুন হাওয়া বইতে দেখা গেল। কয়েকজন লেখক জীবনের নানা দিক পর্যবেক্ষণ করে জীবনের নঞর্থক দিকটাও তুলে ধরলেন। এমন সব গল্প-উপন্যাসের মধ্যে উৎকৃষ্ট রচনাগুলি হলো ওয়াং মং-এর “সাংগঠনিক বিভাগের নতুন যুবকর্মী”, লি চুন-এর “ধূসর রঙের পাল তোলা নৌকা”, নান তিং-এর “সেক্সন অফিসার”, কেং লোংসিয়াং-এর “পার্টি সভ্যপদ লাভ”, কেং চিয়ান-এর “ধ্বজাধারী”। এই সব কাহিনীর যে বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই তা হলো, লেখকেরা সবাই বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্বগুলির পরিবর্তন তাঁদের তীক্ষ্ণ লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সাহসের সঙ্গে সমাজতন্ত্রবিরোধী আমলাতন্ত্রবাদ, সঙ্কীর্ণতাবাদ, আত্মমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আর সমাজের কিছু লোকের অসংবৃত্তি বা অপকর্মের ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলি তাঁদের রচনায় ফুটিয়ে তুললেন। এরই সঙ্গে কিছু প্রেমিক-প্রেমিকার জীবন কাহিনীরও আবির্ভাব হয় যেমন তং ইয়ৌমেই-এর “খাড়া পাহাড়ের ওপর”, লু ওয়েনফু-এর “ছোট গলির গভীরে”, জোং ফু-এর “লাল ডাল” ইত্যাদি। এই সব কাহিনীতে প্রেমীযুগলের ভাব-প্রবণতা, তাদের অন্তরের কথা, অনুরাগ, মান-অভিমান ইত্যাদি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে এবং রসের সঞ্চার করেছে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু বহুমুখী করার প্রয়াসে এবং বাস্তব সমাজের বিভিন্ন দিক প্রতিফলনে এই সব রচনা যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ধরনের রচনা প্রকাশের অনতিকাল পরই এগুলো আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হয়ে উঠল ও তাদের অকালমৃত্যু ঘটল। আর ওয়াং মং, লু ওয়েনফু এবং বহু লেখকের লেখনী স্তব্ধ হলো।
১৯৫৮ সালের “বিরাট উল্লম্ফন” আর সাম্যবাদ এসে গেছে এই ধারণার বশবর্তী হলে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রও সীমিত হয়ে পড়ল। আবার আবির্ভাব হলো সাহিত্যের ক্ষেত্রে “নিষিদ্ধ এলাকা”।
১৯৬১-১৯৬৩ সালের মধ্যে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন নীতি অনুসৃত হবার ফলে এবং সাহিত্যসৃষ্টির পথ আরো উন্মুক্ত করার জন্যে গল্প-উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে আবার নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো। বিষয়বস্তুতেও রকমারিতার আবির্ভাব হলো, বিশেষ করে কিছু ঐতিহাসিক গল্প ও উপন্যাসের আবির্ভাব খুবই লক্ষণীয়। কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশী দিন টিকল না। “মধ্যপন্থী চরিত্র” সৃষ্টির নামে এবং “বাস্তবতাকে আরও গভীরে নিয়ে যাবার” নীতিতে কিছু কিছু গল্প ও উপন্যাস এবং ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত নাটক তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হলো। তাতে গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু আবার সীমিত হয়ে পড়ল, জীবন বর্ণনায় গভীরতার অভাব, চরিত্রসৃষ্টিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাব অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন লোকেদের চরিত্র নয়, একমাত্র বীর-ব্যক্তিদেরই তুলে ধরার প্রতিই ইচ্ছাকৃতভাবে জোর দেবার প্রচেষ্টা। লেখকদের বিভিন্ন শিল্পরীতির প্রতি স্বাভাবিক প্রবণতা “অপ্রলেতারীয় মনোবৃত্তি” বলে সমালোচিত হতে লাগল। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬-এর মধ্যে গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেল। তবু এই সময়পর্বের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো হাও রান-এর “উজ্জ্বল আকাশ” আর ছেন তংখো-এর “ঝড়বিদ্যুৎ” এই দুখানি উপন্যাসে গ্রামে শ্রেণীসংগ্রাম ও দুই লাইনের মধ্যে সংঘাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। এই সময়পর্বে সৈনিকদের জীবন নিয়ে রচিত দুটি সেরা গল্প হলো লিন ইয়ু-এর “পঞ্চাশটি প্রতিবন্ধক” আর রেন উপিন-এর “প্রতিকূল হাওয়ার বিরুদ্ধে নৌচালক”।
মুক্তির প্রথম সতের বছরে গল্প ও উপন্যাস সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। শিল্প ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সত্ত্বেও গল্প ও উপন্যাস সৃষ্টিতে সাহিত্যিকেরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ও শিক্ষা লাভ করেন তাও কোনো অংশে কম নয়।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তৎকালীন দেশরক্ষা মন্ত্রী লিন পিয়াও-এর পৃষ্ঠপোষকতায় চেয়ারম্যান মাও জেতুং-এর পত্নী চিয়াং ছিং, যিনি এর কিছুদিন আগে থেকেই চীনের রাজনীতি ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, শাংহাই শহরে চীনের মুক্তিফৌজের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। এই আলোচনা সভার যে কার্যবিবরণ তাঁরা প্রস্তুত করেন। তাতে বিগত সতের বছরের শিল্প ও সাহিত্যকে “পার্টি বিরোধী, সমাজতন্ত্রবিরোধী এবং মাওজেতুংচিন্তাধারার পরিপন্থী” বলে আখ্যা দেয়া হয়। অচিরেই শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টিতে মাও জেতুং নির্দেশিত পথ প্রত্যাখ্যান করা হলো, সাহিত্য উদ্যানের শত ফুল পদদলিত হলো আর বহু গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার হলেন ‘সংগ্রামের’ লক্ষ্যস্থল। চিয়াং ছিং আর তার গোষ্ঠী শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টিতে একটি ছক বেঁধে দিল। এই ছক-মাফিক গল্প, উপন্যাস বা নাটক না লেখা হলে লেখকের ভাগ্যে জুটতো মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন, কারাবাস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যু। আধুনিক চীনা সাহিত্যের সুসাহিত্যিক লাও শ এবং চাও শুলি’র অকাল মৃত্যু ঘটে এভাবেই। এক অস্বাভাবিক এবং অস্বস্তিকর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে শিল্প ও সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশে ও অগ্রগতিতে যে বাধা ঘটবে তা না বললেও চলে। তবে সাহিত্যসৃষ্টিতে এই পর্যায় যে একেবারে শূন্য ছিল সে-কথা বলা যায় না। যাঁরা ছকবাঁধা রচনায় ব্রতী হলেন তাঁরা শুধু রাজনৈতিক শ্লোগান আওড়ালেন আর ফুটিয়ে তুললেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে উদ্যোগী এক স্বার্থপর গোষ্ঠীর বিকৃত রাজনৈতিক মতবাদ। তাঁদের রচনায় সাহিত্যমূল্য বিশেষ নেই, বাস্তব সমাজের দ্বন্দ্বগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করার চেষ্টাই বেশী ব্যক্তি-পূজাই যেন সাহিত্যসৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য।
এই পর্বের প্রথম দিককার একটি উপন্যাস হলো “হোংনান-এ যুদ্ধের ইতিহাস”। এই উপন্যাসের পটভূমি পঞ্চাশের দশকে কৃষি সমবায় আন্দোলনে উদ্ভূত দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম হলেও বাস্তব অবস্থা ও জীবনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এর ভাষাও ধর্মোপদেশের মতো শোনায়। লিন পিয়াও-চিয়াং ছিং গোষ্ঠীর মতবাদ এতে ব্যক্ত হয়।
তাই এই উপন্যাসটিকে “আদর্শ” বা নমুনা রূপে গ্রহণ করা হয়। নান শাও-এর “নিউ থিয়ানইয়াং” ১৯৫৭ সালে ছাওশান অঞ্চলে স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নিউ থিয়ানইয়াং নামে পরিচিত এক জলাজমিতে বাঁধ দিয়ে তাকে চাষের উপযোগী করবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কিন্তু ১৯৬২ সালে মুক্তিফৌজ এই কাজটি হাতে নিলেই জনগণের আশা পূরণ হয়। এই হলো এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মুক্তিফৌজকে প্রাধান্য দেয়ার প্রচেষ্টায় স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এবং সেনাবাহিনী ও পার্টিকে পরস্পরবিরোধী শক্তিরূপে দেখানো হয়, আর তাতে “পার্টি বন্দুককে নিয়ন্ত্রণ করার” এই মার্কসীয় নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে “বন্দুক পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করবে” এই ভ্রান্ত নীতির গুণগান করা হয়। এই ধরনের অন্যান্য কয়েকটি উপন্যাস হলো হু ইনছিয়াং-এর “পূর্বাহ্ণ”, নু ছ্যুন-এর “আমাদের এই বংশধর”, আর শাংহাই জাহাজনির্মাণ কোম্পানীর শিল্প ও সাহিত্যসৃষ্টি গ্রুপ লিখিত “সমুদ্রে রাস্তা নির্মাণ”। মোটামুটি একই রাজনীতিক লাইন ফুটিয়ে তুললেও সাহিত্য গুণের দৃষ্টিতে যে দুটি উপন্যাস নয়া চীনের সাহিত্য ইতিহাসে উল্লেখ করার মতো যোগ্যতা রাখে তা হলো ছেন রোং-এর “দশ হাজার বছর সবুজ” আর হাও রান-এর “সোনালী পথ”।
এই পর্বে ছোটগল্পের অধিকাংশই নেতাদের প্রবচনের নামান্তর। তবে এই মতান্ধতা কাটিয়ে অপেক্ষাকৃত বাস্তবধর্মী এবং শিল্পরীতির প্রতি যথার্থ মর্যাদা দিয়ে চিয়াং জিলোং লিখেছেন “বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যুরোর ডিরেক্টরের জীবনের একটি দিন”, সুন চিয়ানচোং লিখেছেন “পাহাড়ী ঈগল ডানা মেলেছে”, হৌ চিয়ানপিং লিখেছেন “পথচিহ্ন”, চাং তংখুই লিখেছেন “শব্দবাহী তীর” ইত্যাদি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, চেয়ারম্যান মাও জেতুং-কে হত্যা করে রাষ্ট্র পরিচালনার একচ্ছত্র অধিকার লাভ করার চক্রান্ত ব্যর্থ হলে লিন পিয়াও স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। অতঃপর চীনের রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র চিয়াং ছিং এবং তার অনুগামীদের করায়ত্ত হয়। এর পাঁচ বছরের মধ্যেই চিয়াং ছিং চক্রের পতন হয়। আর চীনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সূচিত হয় এক নতুন যুগ। নয়া চীনের নয়া সাহিত্যের বিকাশের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে তারপর থেকে।
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, “গণ সাহিত্য” মাসিক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী পেইচিংস্থ চীনা সাহিত্যিকদের এক আলোচনা সভা আহ্বান করেন। এই সভায় সাহিত্যিকেরা কি করে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৯৭৮ সালের মে মাসে অখিল চীন শিল্পী ও সাহিত্যিক পরিষদের তৃতীয় বর্ধিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে চীনের প্রাদেশিক শিল্পী ও সাহিত্যিক সমিতি ও তার অধীনস্থ শাখাগুলোকে সক্রিয় করে তুলবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সালেরই দ্বিতীয়ার্ধে অনুশীলনই যে সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার একমাত্র মাপকাঠি তা অনুধাবন করবার জন্য দেশব্যাপী আলোচনা শুরু হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন চীনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পার্টির ঐতিহ্য ও ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার সংকল্প গ্রহণ করে। এর পর যে সব সাহিত্যিক ১৯৫৭ সালের “দক্ষিণপন্থী বিরোধী” আন্দোলনের শিকার হয়েছিলেন এবং লেখক জীবন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তাঁদের এবং “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় অনুরূপ দশায় পড়েছিলেন তাঁদেরও পুনর্বাসিত করা হয়। সাহিত্য সেবায় আবার ব্রতী হওয়ার সুযোগ পেয়ে এঁরা আবার লেখনী তুলে নিলেন। এরপর থেকে কিছু নতুন লেখকেরও আবির্ভাব হতে থাকে। হয়ত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বিগত এক যুগের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেই কথাই গল্প-উপন্যাসে ধরে রাখবার জন্যই এমন কতকগুলো ছোট গল্প ও উপন্যাসের আবির্ভাব হয় যাতে প্রকাশ পায় “ঘায়ের দাগ”। তাই সত্তরের দশকের শেষের দিককার সাহিত্যকে অনেকে “ঘায়ের দাগ” সাহিত্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। ক্রমশঃ সমাজে বিদ্যমান অন্যায়গুলো, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মানবাধিকার, প্রেম ইত্যাদি যে সব বিষয় এযাবৎ সাহিত্যক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ছিল তা আবার গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে ঠাঁই পেতে থাকে।
১৯৭৬ সালেই লেখক মু কুওচেং “আমাদের বাবুর্চি” নামে একটি গল্পে বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং দেশের অর্থনৈতিক গঠনকাজে আত্মনিয়োগকারী একজন বৈজ্ঞানিক “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় যে দুর্দশার মধ্যে পড়েছিলেন। সেই কথাই বর্ণনা করেছেন। এক পারিবারিক জীবনকে কেন্দ্র করে এবং ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত এই গল্পটি ভাষা ও শিল্পরীতির দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত। ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত চিয়াং জিলোং-এর “বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যুরোর ডিরেক্টরের জীবনের একটি দিন” কারখানার শ্রমিক ও কর্মীদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করলেও তৎকালীন নেতারা এর তীব্র সমালোচনা করেন। ফলে, চিয়াংকে সাহিত্য সেবা থেকে বিরত হতে হয়। অবস্থার পরিবর্তন হলে তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে আবার লিখতে শুরু করেন, এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই “রক্তক্ষয়ী হৃদয়”, “ম্যানেজার ছিয়াও-এর পদ গ্রহণ” ও “শেষ বছর” নামে তিনটি গল্প লিখে ফেলেন। “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় ‘রাজনীতিকে’ প্রাধান্য দিয়ে কারিগরী বিদ্যা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রকে হেয় করাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে অরাজকতা ও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সেই বাস্তব চিত্রই তিনি ফুটিয়ে তুললেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে।
“সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” যুগে নেতাদের হুকুমই ছিল আইন। সমাজে আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত কর্মীরা হয়ে পড়লেন আজ্ঞার দাস। যাঁরা নিজেদের বিবেক অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করতেন তাঁদের ভাগ্যে জুটত অশেষ দুর্দশা। এমনই এক দুর্ভাগা পুলিশ-কর্মীকে কিভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে ফেলা হয় সেই কথাই বর্ণিত হয়েছে লেখক ওয়াং ইয়ানফিং-এর “পবিত্র ব্রত” নামে গল্পে।
প্রসিদ্ধ লেখক লিউ সিনউ-এর “ক্লাস টীচার” গল্পটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠক মহলে এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। একজন শিক্ষকের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মাধ্যমে “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” জনজীবনে ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে দুর্দশা ডেকে এনেছিল এবং সমাজে এক বিষময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তার এক বাস্তবভিত্তিক চিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
উ ছিয়াং-এর “আত্মার সংগ্রাম” এবং ওয়াং মং-এর “অমূল্য” নামে গল্প দুটিতে “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় কয়েকজন সত্যাশ্রয়ীর মনের গভীরে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং নিরুপায় হয়ে তাঁরা যে অন্তরের জ্বালা অন্তরেই জমা রাখতেন সেই কথা ব্যক্ত হয়েছে।
আশির দশক থেকে আবির্ভাব হতে থাকে জীবনের নানা দিক এবং মানুষের অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে লিখিত বহু গল্প ও উপন্যাস। নতুন কৃষি নীতির জন্য ১৯৭৯ সাল থেকে গ্রামীণ চীনে যে পরিবর্তন আসতে থাকে সেই চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন কু হুয়া এবং অন্যান্য কয়েকজন লেখক। “তিক্ত বসন্ত-এক ট্রাক চালকের কাহিনী” গল্পে প্রবীণ লেখক চাং সিয়ানলিয়াং চীনের সুদূর পশ্চিমাঞ্চলে এক ট্রাক চালকের জীবনী বর্ণনা করেছেন। ১৯৮০ সালে মহিলা লেখিকা শেন রোং-এর “মধ্যবয়স এলে” গল্পটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং তা খুব বিতর্কেরও সৃষ্টি করে। এই গল্পে লেখিকা মূলতঃ মধ্যবয়সী বুদ্ধিজীবীদের সমস্যা প্রতিফলিত করেছেন। লেখিকা চাং চিয়ে-এর “বনের সঙ্গীত” নামক গল্পে মধ্যবয়সী আমলাসুলভ কর্মীদের বাস্তব অবস্থার প্রতি পরাখ হবার কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তাঁর “ভালবাসা ভুলবার নয়” কাহিনীটি নিছক প্রেমকাহিনী নয়, এটি শিক্ষামূলকও বটে। এক বেকার মেয়ের জীবনকে কেন্দ্র করে গল্প লিখেছেন তং কেং। যুগের পরিবর্তন এলেও অনেকে যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারলেন না, এমনই এক জেদী আর গোঁড়া চরিত্র উপস্থাপিত করেছেন নবীন লেখক লি হাং ইয়ু তাঁর “শেষ আঁকশি” গল্পে। “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় নির্যাতিত ও নির্বাসিত লেখক লু ওয়েনফু-এর “সীমানার পাঁচিল” একটি ব্যঙ্গ রচনা।
মোট কথা, লেখকেরা এখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওজেতুংচিন্তাধারার প্রতি নিষ্ঠা রেখে সাহিত্য সেবায় ব্রতী হয়েছেন। অবশ্য এঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারেন। তার জন্য তাঁরা সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠলেও তাঁদের রচনা সাহিত্য সমালোচনার স্বাভাবিক মাপকাঠিতেই বিচার্য হবে। তাই বলে তাঁদের হাত থেকে লেখনী ছিনিয়ে নেয়া হবে না। আজকের দিনের সাহিত্যিকেরা এই নিশ্চয়তা পেয়েছেন বলেই নয়া চীনের নয়া সাহিত্যের উদ্যানে বর্তমানে নানা প্রকার ফুল বিকশিত হতে শুরু করেছে।
সেন নালান
নয়া চীনের গল্পসংকলন
: সংকলনসমূহ :
নয়া চীনের গল্পসংকলন (১৯৪৯-১৯৫৯)
নয়া চীনের গল্পসংকলন (১৯৬০-১৯৬৯)
নয়া চীনের গল্পসংকলন (১৯৪৯-১৯৫৯)
নয়া চীনের গল্পসংকলন (১৯৬০-১৯৬৯)
Post a Comment