মানিক বিচিত্রা - বিশ্বনাথ দে

manik-bichitra





প্রকাশনা তথ্য


প্রথম প্রকাশ
প্রথম প্রকাশ - ১৯৫৬


প্রথম বৈদ্যুতিন সংস্করণ
মার্চ ২০২৩, ফাল্গুন ১৪২৯


প্রচ্ছদ


প্রকাশক
সুনীল আকাশ আত্মপ্রকাশ কেন্দ্র (SAAP) প্রকাশনা,
1215-40, Gordonridge Place,
Scarborough, Ontario : M1K 4H8, Canada.






                                                                                                                     
লেখক সম্পর্কে

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে, ১৯০৮ - ৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৬) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথা-সাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্যজগৎে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার রচনায় ফুটে উঠেছে। জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি রচনা করেন চল্লিশটি উপন্যাস ও তিনশত ছোটোগল্প। তার রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্পসংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ইংরেজি ছাড়াও তার রচনাসমূহ বহু বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ) বিহারের সাঁওতাল পরগনা,বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরের বর্তমান লৌহজং এ। জন্মপত্রিকায় তার নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। তার পিতার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার আর ডাকনাম মানিক। তার পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবণি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের লৌহজংএর গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আভ্যন্তরিক রিয়ালিজম ঘেঁষা মনোভাব তাঁকে শিল্পজীবনের সৌন্দর্যের আদর্শ থেকে দৃষ্টি গ্রাহ্যভাবেই বিচ্যূত করেছে। এমন কি মধ্য ও শেষের দিকের লেখায় তিনি সচেতনভাবেই অসুন্দরের পূজারী হয়ে উঠেছিলেন বললেও অন্যায় হবে না।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন।

কলেজ ক্যান্টিনে একদিন আড্ডা দেওয়া অবস্থায় এক বন্ধুর সাথে মানিক বাজী ধরেন তিনি তার লেখা গল্প বিচিত্রায় ছাপাবেন। সে সময় কলকাতায় বিচিত্রা পত্রিকা ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত এবং কেবল নামকরা লেখকেরাই তাতে লিখতেন। বন্ধুর সাথে বাজি ধরে মানিক লিখে ফেললেন তার প্রথম গল্প “অতসী মামী” এবং সেটি বিচিত্রার সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দেন। গল্পের শেষে নাম সাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হিসাবে। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লেখাটি পাঠানোর চার মাস পর বিচিত্রায় ছাপেন। প্রকাশের সাথে সাথেই গল্পটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক। সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশের ফলে তার একাডেমিক পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়; শেষাবধি শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। সাহিত্য রচনাকেই তিনি তার মূল পেশা হিসেবে বেছে নেন।

পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মানিক কয়েকমাস একটি সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তার লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৬ সালে প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবণি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা। চাকরি সূত্রেই তার পিতা সাঁওতাল পরগনার দুমকায় গমন করেন। সেখানেই মানিকের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের কারণে ঐ সকল মানুষের জীবনচিত্র সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ছিল মানিকের। তাই ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রকে তার সাহিত্যে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। বিচিত্র সব মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন লেখক। তার এই সকল অভিজ্ঞতাকেই তিনি তার সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বিচিত্র সব চরিত্রের আড়ালে। পদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার পটভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি।

জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছাড়া মার্কসবাদও তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তার অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তারাধিকারী। তার প্রথম গল্পগুচ্ছ অতসী মামী ও অন্যান্য সংকলনে সব কয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস দিবারাত্তির কাব্য মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনী নিয়ে গড়া। এছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন চিত্রও তার বেশকিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তার সাহিত্যের মুল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙ্গা গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তার সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণবঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০ টি উপন্যাস এবং ৩০০ টি ছোট গল্প রচনা করেছেন। তার লেখা অন্যতম ছোটগল্প হলো মাসি-পিসি। যেটি সর্বপ্রথম ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে লেখক মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা পরবর্তী কালে জটিল অবস্থায় গমন করে। জীবনের শেষদিকে তীব্র আর্থিক কষ্টে ভুগেছেন তিনি। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ৩রা ডিসেম্বর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে।

‘মানিক বিচিত্রা’ প্রসঙ্গে

‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ যখন প্রথম পড়ি তখন আমার বয়স বড়জোর আঠারো কি উনিশ। পুতুলনাচ ঠিক কেমন দেখতে তখনো জানি না, পদ্মা নদীর মাঝি দূরে থাক, পদ্মা নদীই তখনো চোখে দেখিনি কিন্তু উপন্যাস দুটি আমার সেদিনের তরুণ মনে কী অপার রোমাঞ্চ সৃষ্টি করেছিল তা আজ ভাবতেও অবাক লাগে! শশী ডাক্তার ও কুসুম কি জানি কেন সেদিন আমার সমস্ত মন অধিকার করে নিয়েছিল, কুবের ও কপিলার অন্তর্দাহ আমার নিজের মনকেও কম দগ্ধ করেনি আর ময়না দ্বীপের হোসেন মিঞার বিচিত্র-বিস্ময়কর চরিত্র সেদিনকার কাঁচা মনে কী গভীর রহস্যের স্বাক্ষরই না রেখেছিল। কিন্তু আমাকে সবথেকে অভিভূত করেছিল এই উপন্যাস দুটির নেপথ্য নায়ক যাদুকর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনও এই যাদুকরটি কেমন দেখতে, কোথায় থাকেন, কি করেন কিছুই জানি না, কেবল জানি বই দুটির মলাটের মধ্যকার অতল রহস্যের কথা যে রহস্য যে-কোনো সংবেদনশীল মনকে আচ্ছন্ন না করে পারে না।

এর কয়েক বছর বাদেই সেই যাদুকরের সঙ্গে যেদিন প্রথম পরিচয় হল, কোথায় মিলিয়ে গেল পুতুলনাচের রোমাঞ্চ ও পদ্মা নদীর ইলিশ মাছের গন্ধ। হোসেন মিঞার সেই আশ্চর্য দ্বীপের কথাও আর মনে রইল না। কেবল মন জুড়ে রইল মানিকবাবুর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব যে ব্যক্তিত্ব কাছে টানে, গভীরে আকর্ষণ করে এবং আরও নিভৃতে নিয়ে গিয়ে সম্মোহিত করে।

এই সংকলনের মুখবন্ধ রচনা করতে বসে আমার আঠারো-উনিশ বছর বয়সের স্মৃতিচারণা না করে পারলাম না কারণ পরবর্তী কালে মানিকবাবুর অত্যন্ত কাছাকাছি থাকার সময়েও আমার তরুণ বয়সের এই ভাবাবেগের কথা কিছুতেই বিস্মৃত হতে পারিনি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকে মোটামুটি দুটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে—একটি যুদ্ধপূর্ব, অপরটি যুদ্ধোত্তর। অর্থাৎ তাঁর আটাশ বছরের সাহিত্য-জীবন সময়ের হিসেবে দুটি ভাগে বিভক্ত—১৯২৮ থেকে ১৯৪২ ও ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৬। প্রথম ভাগে মানিকবাবু মনোবিকলনের সুড়ঙ্গপথের জটিলতার মধ্যে দিয়ে মানব-জীবনের রহস্য-সন্ধানে ও উন্মোচনে ব্যস্ত যার একদিকে আদিম মানুষের প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার, অন্যদিকে অসুস্থ মধ্যবিত্ত মনের সরীসৃপ কুটিলতা। দ্বিতীয় ভাগে তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের এই অবক্ষয়কে তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে প্রয়াসী হয়েছেন নির্মোহ মন ও বৈজ্ঞানিক চেতনার ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে। যত অসম্পূর্ণতা ও অসংলগ্নতার অভিযোগ করি না কেন, এই অংশে তিনি জীবনের সহস্র জটিলতার মধ্যেও খেই খুঁজে পেয়েছেন।

বর্তমান সংকলনের সম্পাদক বিভিন্ন চিন্তাশীল লেখকের মূল্যবান রচনাগুলিকে একসূত্রে গেঁথে মানিকবাবুর বহুধাবিস্তৃত সাহিত্যজীবনের প্রেক্ষাপটকে পাঠকদের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ‘মানিক-বিচিত্রা’র অধিকাংশ রচনাই মানিকবাবুর মৃত্যুর পর রচিত। ফলে সেখানে জমা-খরচের খাতায় অঙ্কের কোনো গোঁজামিল নেই। প্রতিটি লেখকই নিঃসংকোচে তাঁর বক্তব্য উপস্থিত করেছেন—কোথাও তা গুরুভার প্রশস্তির চাপে ভারাক্রান্ত হয়নি। রচনাগুলি ছড়িয়ে ছিল নানা পত্র-পত্রিকায়। বলতে গেলে পত্রিকার জীর্ণ পৃষ্ঠার অন্তরালে হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল সেগুলির। উদ্যোগী সম্পাদক সেই প্রায়-বিস্মৃত রচনাগুলিকে বিস্মৃতির গর্ভ থেকে তুলে এনে নতুন জীবন দান করেছেন। সম্পাদক হিসেবে এটা তার সব থেকে বড় কৃতিত্ব। আর এরই জন্যে পাঠক হিসেবে আমরা তাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

প্রায় ৪০খানি উপন্যাস, ১৯২টি ছোট গল্প, একটি নাটক ও সম্প্রতি প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থ—মানিকবাবুর সাহিত্য-জীবনের এই মোট ফসল। তাঁর জীবদ্দশায় এই ফসলকে সমালোচনার নিরিখে যাচাই করার অবকাশ ঘটেনি। কারণ পাঠক বা সমালোচক কেউই ভাবতে পারেননি যে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে সৃষ্টির বিকিকিনি সাঙ্গ করে মানিকবাবু ইহলোক থেকে বিদায় গ্রহণ করবেন। আমরা সবাই ভেবেছিলাম তিনি আরও দীর্ঘদিন আমাদের মধ্যে থাকবেন এবং বহু অমূল্য উপহার দিয়ে যাবেন, আর তারই মধ্যে আমরা পাব তাঁর যুদ্ধোত্তর কালের নতুন চৈতন্যের পরিণত ফলশ্রুতি। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তাঁর অকালমৃত্যু—যার জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না—এই মহৎ সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করেছে।

সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ে ব্যক্তি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কম কৌতূহলোদ্দীপক ছিলেন না। মানিকবাবুকে যাঁদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁরাই জানেন এমন নিরভিমান ব্যক্তিত্ব, অদম্য প্রাণশক্তি ও অটল আত্মপ্রত্যয় সহজে চোখে পড়ে না। এমন সুগভীর আন্তরিকতা, নিরঙ্কুশ সততা ও শত কৃচ্ছতার মধ্যে অপার আতিথেয়তা—এতগুলি গুণের এমন নিষ্কলুষ সমাহার একটি মানুষের মধ্যে কদাচিৎ ঘটে। টালিগঞ্জের চণ্ডিতলার দোতলা পৈতৃক বাড়ি থেকে বরানগরের গোপাললাল ঠাকুর রোডের দীনহীন একতলা বাসাবাড়ি—মানিকবাবুকে অসংখ্যবার অসংখ্যরূপে দেখেছি আর মুগ্ধ হয়েছি তার অসামান্য ব্যক্তিত্বে। ম্যাডান স্ট্রীটে ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের তিনতলার ঘর থেকে যেদিন তাঁর কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তরে উত্তরণ ঘটল তারপর থেকে তাঁকে পার্টির ঘরোয়া সভা-সমাবেশে, ময়দানের জনসভায়, সাহিত্য-সম্মেলনে, অগ্রণী স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় পতাকা হাতে মিছিলের পুরোভাগে অনেকবার দেখেছি এবং বিস্মিত হয়েছি তাঁর প্রাণশক্তিতে। বিস্ময় এইজন্যে যে শিল্প-সাহিত্য জগতের এই ঘোড়সওয়ারকে সামান্য পদাতিকের ভূমিকায় দেখব বলে প্রত্যাশা করিনি। মনে আছে ১৯৪৯ সালে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর সরকারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সংস্কৃতিসেবীদের এক সভা হয়। মানিকবাবু এই সভায় কেবল বক্তৃতাই করেননি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে মিছিল বের হয় তার পুরোভাগেও ছিলেন। পুলিশ ঐ মিছিলকে কলেজ স্ট্রীট-মির্জাপুর স্ট্রীটের মোড়ে আটক করে গুলিবর্ষণ করে। সেদিন রাত্রে ছত্রভঙ্গ জনতার ভিড়ে বিমূঢ় মানিকবাবুকে পুঁটিরামের দোকানের বারান্দার নিচে খুঁজে পেয়েছিলাম। পরবর্তী কালে আমরা মানিকবাবুর মতো শিল্পীকে এইরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়াটাকে চরম হঠকারি বলে অভিহিত করেছিলাম।

‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকার দপ্তরে মানিকবাবু অনেকবার এসেছেন—কখনো নিছক গল্প করতে বা খবরা-খবর নিতে, কখনো বা ‘ইতিকথার পরের কথা’র কিস্তি দিতে, হাতলভাঙা কাপে চা খেয়ে গেছেন বহুবার, আমাদের আড্ডায় মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক ও অন্যান্যদের সঙ্গে প্রাণখোলা আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। তখনো তাঁর মননদীপ্ত ব্যক্তিত্ব আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত ও অনুপ্রাণিত করেছে।

একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা এখানে লিপিবদ্ধ করে রাখতে চাই। ঘটনাটি যত ছোট হোক, মানিকবাবুর মহৎ ও উদার চরিত্রের নিদর্শন বলে গণ্য হতে পারে। খুব সম্ভবতঃ ১৯৫৪ সালের কথা। ‘শারদীয় নতুন সাহিত্যে’র জন্যে মানিকবাবুর কাছে একটি গল্প চেয়েছিলাম। শেষ মুহূর্তে হলেও গল্পটি পেয়েও ছিলাম। লেখাটি পড়ে কিন্তু খুশি হতে পারিনি। ধৃষ্টতা জেনেও পরদিন পিওন দিয়ে লেখাটি ফেরৎ পাঠিয়েছিলাম। সঙ্গে অবশ্য মাফ চেয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। মহালয়ার তখন মাত্র ২৩ দিন বাকি। কাগজ বের করতে এত ব্যস্ত যে নিজে গিয়ে উঠতে পারিনি। মানিকবাবু লেখাটি ফেরৎ পেয়ে গম্ভীর মুখে পত্রবাহককে বলেছিলেন, ‘তোমার বাবুকে দেখা করতে বোলো।’ লোকমুখে শুনলাম তিনি মনে মনে ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ক্ষুব্ধ হওয়া অন্যায় নয়। আপনার লোকের কাছে আঘাত পেলে মানুষ ক্ষুব্ধ হয় সবচেয়ে বেশি। বিজয়ার পর একদিন সস্ত্রীক দেখা করতে গেলাম। মানিকবাবু কিন্তু ঠিক আগের মতোই তেমনি আন্তরিক, তেমনি অমায়িক। বললাম, ‘শুনেছি, আপনি আমার ওপর ভয়ানক রাগ করেছেন। আমার ধৃষ্টতা মাফ করবেন।’ মানিকবাবু উত্তর দিলেন, ‘রাগ করেছি ঠিকই কিন্তু লেখাটা ফেরৎ দিয়েছেন বলে নয়। লেখা ফেরৎ দেবার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু তাই বলে আমার লেখা আপনি পিওন দিয়ে ফেরৎ পাঠাবেন? নিজে আসতে পারলেন না?’ তারপরই কমলাদিকে চা করতে বলে গরম সিঙ্গাড়া আনতে বেরিয়ে গেলেন। বরানগরের বাড়িতে গেলে এই গরম সিঙ্গাড়া তিনি প্রায়ই খাওয়াতেন।

মানিকবাবুর মতো লেখকের লেখা ফেরৎ দেবার মতো দুঃসাহস কেন হয়েছিল জানি না। নিজের মনে এর ঔচিত্য অনৌচিত্য নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছি। এটা কি নিতান্তই যৌবনের দুঃসাহসিকতা? না কি এর পেছনে ছিল মানিকবাবুর প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যা তাঁর কাছ থেকে সর্বদা বৃহৎ কিছু পাবার জন্যে মনকে উন্মুখ করে রাখতো। যাইহোক, সেদিন মনে মনে মানিকবাবুর ব্যক্তিত্বের কাছে হার স্বীকার না করে পারিনি।

প্রসঙ্গতঃ আর একটি ঘটনা উল্লেখ করবো। মানিকবাবু বিনা পারিশ্রমিকে কোনো লেখা দিতে চাইতেন না। বলতেন, লেখা আমার পেশা। লেখাই আমার জীবিকা। শ্রমিক যদি দিন-মজুরি করে পয়সা পায়, আমি মগজ খাটিয়ে গল্প লিখে পারিশ্রমিক পাব না কেন? এমন কি ‘স্বাধীনতা’র লেখার জন্যেও তাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে। অবশ্য সে টাকা উনি নিজে নেবেন না, শেষ পর্যন্ত পার্টি, তহবিলেই দান করবেন। একবার শারদীয় ‘স্বাধীনতা’র গল্পের টাকা পেতে অনেক বিলম্ব হচ্ছিল। পরে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ জানালেন তারাই নাকি টাকাটা নিজেদের তহবিল থেকে তুলে পার্টি তহবিলে দিয়ে দিয়েছেন। খবরটা শুনে মানিকবাবু রীতিমতো বিচলিত হলেন। বললেন, ‘এ কেমন কথা! আমার টাকা আমি দান করবো। ‘স্বাধীনতা’ কর্তৃপক্ষকে আমার টাকা দান করার এক্তিয়ার কে দিয়েছে?’

এ হেন মানিকবাবুকে যখন আমাদের সঙ্গে শ্রমিক-বস্তিতে রাস্তার ধারে নিতান্ত দীনহীন চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে রাজনীতির গল্প করতে দেখেছি তখন মনে হয়েছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র স্রষ্টা সত্যিই নতুনতর জীবনের পাঠ নিচ্ছেন। কিংবা আই-পি-টি-এর শো ভাঙার পর শেষরাত্রে যখন মানিকবাবু মফস্বল শহর বা উপকণ্ঠের শিশির-ভেজা মাঠের আল ভেঙে রেলস্টেশনের উদ্দেশে পাড়ি দিতেন—কখনো অন্ধকারে, কখনো জ্যোৎস্নারাত্রে তার বুদ্ধিদীপ্ত অস্পষ্ট মুখের দিকে সন্তর্পণে তাকিয়ে দেখেছি আর ভেবেছি—এক বৃহৎ অন্বেষা এই মানুষটিকে ঘরের চতুষ্কোণ ছেড়ে বিরাট বিশ্বের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে!

বলা বাহুল্য, ১৯৪৩ সাল থেকে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত মানিকবাবুকে রাজনীতি, সাহিত্যকর্ম, সংসারধর্ম, নিছক আড্ডা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে এবং প্রতিবারই যেন তিনি একটি করে নতুন পৃষ্ঠা উন্মোচিত করেছেন আমার চোখের সামনে।

অবশেষে তার আকস্মিক মৃত্যু! আকস্মিক মৃত্যু না পরিকল্পিত আত্মহনন? প্রবল আত্মবিশ্বাসের মধ্যেও কি প্রবল হতাশা এই সংগ্রামী শিল্পীটিকে অত্যন্ত সন্তর্পণে আত্মঘাতী হতে সাহায্য করেনি? হলপ করে কে বলবে একথা?

প্রকাশিত গ্রন্থ

মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ:


উপন্যাস

জননী (১৯৩৫)

দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫)

পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬)

পদ্মানদীর মাঝি(১৯৩৬)

জীবনের জটিলতা (১৯৩৬)

অমৃতস্য পুত্রাঃ (১৯৩৮)

শহরতলি (প্রথম খণ্ড) (১৯৪০)

শহরতলি (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৯৪১)

অহিংসা (১৯৪১)

ধরাবাঁধা জীবন (১৯৪১)

চতুষ্কোণ (১৯৪২)

প্রতিবিম্ব (১৯৪৩)

দর্পণ (১৯৪৫)

চিন্তামণি (১৯৪৬)

শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬)

চিহ্ন (১৯৪৭)

আদায়ের ইতিহাস (১৯৪৭)

জীয়ন্ত (১৯৫০)

পেশা (১৯৫১)

স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫১)

সোনার চেয়ে দামী (প্রথম খণ্ড) (১৯৫১)

সোনার চেয়ে দামী (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৯৫২)

ইতিকথার পরের কথা (১৯৫২)

পাশাপাশি (১৯৫২)

সার্বজনীন (১৯৫২)

নাগপাশ (১৯৫৩)

ফেরিওয়ালা (১৯৫৩)

আরোগ্য (১৯৫৩)

চালচলন (১৯৫৩)

তেইশ বছর আগে পরে (১৯৫৩)

হরফ (১৯৫৪)

শুভাশুভ (১৯৫৪)

পরাধীন প্রেম (১৯৫৫)

হলুদ নদী সবুজ বন (১৯৫৬)

মাশুল (১৯৫৬)

গল্প-সংকলন

অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫)

প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭)

মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮)

সরীসৃপ (১৯৩৯)

বৌ (১৯৪০)

সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩)

ভেজাল (১৯৪৪)

হলুদপোড়া (১৯৪৫)

টিকটিকি

হারানের নাতজামাই

আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬)

পরিস্থিতি (১৯৪৬)

খতিয়ান (১৯৪৭)

মাটির মাশুল (১৯৪৮)

ছোট বড় (১৯৪৮)

ছোট বকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯)

ফেরিওলা (১৯৫৩)

লাজুকলতা (১৯৫৪)

আত্নহত্যার অধিকার

নাটক

ভিটেমাটি (১৯৪৬)

প্রবন্ধ সংকলন

লেখকের কথা - সেপ্টেম্বর-১৯৫৭, ভাদ্র-১৩৬৪

কাব্যগ্রন্থ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা - যুগান্তর চক্রবর্তী (সম্পাদিত) মে-১৯৭০, জ্যৈষ্ঠ-১৩৭৭

ডায়েরি ও চিঠিপত্র

অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় - যুগান্তর চক্রবর্তী (সম্পাদিত) আগস্ট-১৯৭৬, শ্রাবণ-১৩৮৩

Share:

Post a Comment

Copyright © SAAP Publication.